হাসপাতালে করোনা রোগীদের প্রকৃত সংখ্যা অজানা

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ঠিক কতজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুধু করোনার জন্য সরকার নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে কত রোগী ভর্তি, সেটি জানাচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে এখন অনেক করোনা রোগী চিকিৎসাধীন। তাঁদের তথ্য জানাচ্ছে না অধিদপ্তর।

করোনার চিকিৎসার জন্য সরকার নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে এখন শয্যা আছে ১৪ হাজার ৭২০টি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এসব হাসপাতালে গতকাল শনিবার ভর্তি ছিলেন ৪ হাজার ৪০৩ জন, যা মোট রোগীর মাত্র ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ, ৭২ শতাংশ শয্যাই খালি পড়ে ছিল। আবার নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) রয়েছে ৩৭৯টি। গতকাল আইসিইউতে ছিলেন ২১৬ জন। অর্থাৎ, আইসিইউর ৪৩ শতাংশ শয্যা ফাঁকা ছিল। এসব হাসপাতাল ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কত করোনা রোগী চিকিৎসাধীন, সেই তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে না।

রাজধানীর শ্যামলীতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধাসহ ৪২ শয্যার করোনা ইউনিট রয়েছে। গত জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে বেসরকারি এই হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে। হাসপাতালের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আল ইমরান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ সময়ই সব শয্যাতেই রোগী থাকছেন।

রাজধানীর গ্রিন রোডের গ্রিনলাইফ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য শয্যা রয়েছে ১০০টি। দৈনিক গড়ে ৭০ জনের বেশি করোনা রোগী ভর্তি থাকছেন এখানে। একইভাবে ল্যাবএইড হাসপাতালেও দৈনিক ৮০ থেকে ৯০ জন করোনা রোগী ভর্তি থাকছেন।

মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনার জন্য শয্যা রয়েছে ৩৫টি। হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিকিৎসক আশীষ কুমার চক্রবর্তী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের হাসপাতালে করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদেরও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর দিনে ১০ থেকে ১২ জন করোনা শনাক্ত হওয়া রোগী ভর্তি থাকছেন।

পশ্চিম রাজাবাজারের বাসিন্দা ব্যবসায়ী ফারুক খানের করোনা শনাক্ত হয় ২৩ জুন। তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ২৪ জুন। ২০ দিন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন ১৩ জুলাই। তাঁর মেয়ে সুমাইয়া বিনতে ফারুক বলেন, পরিচিত যাঁরা করোনার জন্য সরকার নির্ধারিত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়।

করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে গত ২৪ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়, ৫০ শয্যা বা তার বেশি শয্যাবিশিষ্ট সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড এবং নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক ব্যবস্থা করতে হবে। ওই নির্দেশনার পর জুন মাস থেকে রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরের বেশ কিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিকে করোনার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। তবে বেসরকারি কত হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা চলছে, সেই তথ্যও প্রকাশ করছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ঢাকা জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে কত করোনা রোগী ভর্তি আছেন, তা জানতে চাইলে সিভিল সার্জন আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, এখন তো সব হাসপাতালেই কমবেশি করোনা রোগীদের চিকিৎসা হচ্ছে। ঢাকা জেলার কোন হাসপাতালে কত করোনা রোগী আছেন, সেই তথ্য জানা যাচ্ছে না। তবে হাসপাতালগুলো ভর্তি রোগীর তথ্য সরাসরি অধিদপ্তরের কাছে চাইলে দিতে পারে।

>

বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে অনেক রোগী চিকিৎসা নিলেও তাঁদের তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে যুক্ত করা হচ্ছে না
করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে শয্যা আছে ১৪ হাজার ৭২০টি
গতকাল ভর্তি ছিলেন ৪ হাজার ৪০৩ জন।
রাজশাহী বিভাগে মোট শয্যার ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশই ফাঁকা

ঢাকার বাইরে বগুড়ায় বেসরকারি টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ ও রাফাতুল্লাহ কমিউনিটি হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি করা হচ্ছে। এই হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ সুবিধাসহ ১৬০ শয্যার করোনা ইউনিট রয়েছে। এখানে দৈনিক ৭০ থেকে ৮০ জন করোনা রোগী ভর্তি থাকছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়শা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, এখন শুধু করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের তথ্য দেওয়া হচ্ছে। অন্য হাসপাতালগুলোতে যেসব করোনা রোগী ভর্তি, তাঁদের তথ্য এখানে যুক্ত নেই। অন্যান্য হাসপাতালের তথ্য সফটওয়্যারে ইনপুট দেওয়া হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে সেসব হাসপাতালের তথ্যও জানা যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া করোনাবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে শুরু থেকেই ঘাটতি রয়েছে, এমনটা বারবার বলে আসছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করেন, অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য দেশের করোনা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র নয়। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর পূর্ণাঙ্গ তথ্য না থাকাও অব্যবস্থাপনারই অংশ।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে করোনাবিষয়ক তথ্য ব্যবস্থাপনায় বড় ঘাটতি রয়েছে। রোগতাত্ত্বিকভাবে যেভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন, তা করা হচ্ছে না। ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নির্ধারিত হাসপাতালে রোগী নেই

রাজশাহী বিভাগের ৮টি জেলার হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা ১ হাজার ৬২০টি। এসব শয্যায় গতকাল রোগী ভর্তি ছিলেন মাত্র ২০১ জন। অর্থাৎ, মোট শয্যার ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশই ফাঁকা। রাজশাহী বিভাগে কোভিড-১৯ রোগী রয়েছেন সাড়ে ৫ হাজার। এর মধ্যে মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক গোপেন্দ্র নাথ আচার্য্য প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের মৃদু উপসর্গ, তাঁদের বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে থাকতে রোগীদের মধ্যে ভীতিও কাজ করছে। বাড়ির পরিবেশে থাকায় রোগীরা মানসিকভাবে চাঙা থাকছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সর্বনিম্ন ৩৭ শতাংশ শয্যা ফাঁকা রয়েছে বরিশাল বিভাগে। ঢাকা মহানগরীর ৭২ শতাংশ আর ঢাকা বিভাগে ৮৫ দশমিক ৬ শতাংশ শয্যা ফাঁকা। চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৯ শতাংশ শয্যাতে কোনো রোগী নেই। ময়মনসিংহ বিভাগে ৮৩ শতাংশ, রংপুরে ৮৫ শতাংশ, খুলনায় ৬৬ শতাংশ ও সিলেট বিভাগের করোনার জন্য নির্ধারিত শয্যার ৬২ শতাংশ ফাঁকা রয়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালগুলোতে শয্যা ফাঁকা থাকার বড় কারণ আস্থাহীনতা। রোগীরা ভাবছেন, হাসপাতালে গেলে সেবা পাবেন না। যাঁরা বেশি অসুস্থ তাঁরাও বাসায় থাকায় হঠাৎ শারীরিক অবস্থা জটিল হচ্ছে। রোগীদের আস্থা তৈরিতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।