সপ্তাহের ব্যবধানে মা-বাবাকে হারালেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী চার বোন
চারটি মেয়েই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। এ সমাজে এই মেয়েদের মাকে কম কথা শুনতে হয়নি। তবে তাঁদের মা-বাবা চার মেয়েকেই আগলে রেখেছিলেন। চার মেয়েকেই হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছেন। হাত ধরে নিয়ে গিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মেয়েদের। তবে করোনাভাইরাসের তাণ্ডবের সময় নানা ভোগান্তি শেষে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে চার বোনই হারিয়ে ফেলেছেন তাঁদের বাবা ও মাকে।
মা, বাবা আর নিজেদের চেষ্টায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া চার বোন হলেন চট্টগ্রামের উম্মে হাবিবা চৌধুরী, উম্মে সালিমা চৌধুরী, উম্মে তাসলিমা চৌধুরী ও উম্মে তানজিলা চৌধুরী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে উম্মে সালিমা চৌধুরী ছাড়া অন্য তিন বোনই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তাসলিমা ও তানজিলা বিয়ে করেছেন। তানজিলা এক সন্তানের মা হয়েছেন দুই মাস আগে। উম্মে সালিমা চৌধুরী বাবা, মা আর ভাইয়ের সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে থাকতেন। অন্য তিন বোন চাকরির জন্য পটিয়ায় থাকেন।
জন্ম থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এই চার বোন বাবা নাছির উদ্দিন চৌধুরী ও মা শামীমা আক্তার চৌধুরীকে কখনোই দেখতে পাননি। তবে তাঁরা মা–বাবাকে পদে পদে অনুভব করতেন। একসঙ্গে বাবা ও মা মারা যাওয়ায় এই চার বোনই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে কথা হয় তাসলিমা ও তানজিলার সঙ্গে। জানালেন, তাঁদের বাবার করোনা টেস্টের সনদ হাতে না থাকায় হাসপাতালে ভর্তিই করতে পারেননি। অথচ মৃত্যুর পর করোনা টেস্টে জানা গেছে, করোনা নেগেটিভ ছিল তাঁদের বাবার। আর মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারলেও চিকিৎসা ঠিকমতো পাননি বলে অভিযোগ করলেন এই চার বোন।
তাসলিমা জানান, শামীমা আক্তার চৌধুরী স্ট্রোক করেন। ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জটিলতাও ছিল। চার বোন মাকে নিয়েই বেশি চিন্তায় ছিলেন। তবে এর মধ্যেই তাঁদের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করে, পরিচিত বিভিন্ন মহলে তদবির করেও নাছির উদ্দিন চৌধুরীকে কোথাও ভর্তি করতে পারেননি তাঁরা। পরে ২ জুন তিনি বাসায় মারা যান। আর ১০ জুন হাসপাতালে মারা যান শামীমা আক্তার চৌধুরী।
তানজিলা বললেন, ‘আমার বাচ্চার বয়স দুই মাসও হয়নি। বাবার করোনা হতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। তাই বাবা মারা যাওয়ার আগে বাবাকে দেখতেও যেতে পারিনি। বাবাও চাননি আমি বাচ্চা নিয়ে এই সময় তাঁর কাছে যাই। মাকেও দেখতে পারিনি।’
তাসলিমা বললেন, ‘বাবা ব্যবসা করতেন। সেই অর্থে আমরা কখনোই বিত্তশালী ছিলাম না। এই সমাজে চারটি মেয়েই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলে ওই পরিবারটির কী দশা হয়, তা সবাই বুঝতে পারছেন। মাকে আত্মীয়দের অনেকে পাপিষ্ঠা বলতেও ছাড়েননি। তবে বাবা ছিলেন মায়ের একমাত্র সঙ্গী। বাবা মায়ের হাতটা ধরে ছিলেন সারা জীবন। বাবা সব সময় বলতেন, তাঁর মেয়েদের আল্লাহ পাঠিয়েছেন। তাই মেয়েদের কোনো অযত্ন করা যাবে না। মেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সারা জীবনই মা–বাবাকে আমাদের নিয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে। হাত ধরে হাঁটতে শেখানো, হাত ধরে স্কুলে নেওয়া—সবই করতেন আমাদের বাবা। আমরা চার বোন কখনোই কোনো অবহেলা পাইনি মা–বাবার কাছ থেকে।’
তাসলিমা বলেন, ‘আমাদের এক ভাইও আমাদের আগলে রাখেন সব সময়। প্রায় একসঙ্গে মা–বাবা মারা যাওয়ায় আমাদের ভাই বোনদের মাথার ওপর থেকে ছাতাটাই সরে গেল। বাবা ও মা অনেক কষ্ট নিয়ে মারা গেলেন। মাকে তবু হাসপাতালে ভর্তি করতে পেরেছিলাম, বাবাকে তো ভর্তিও নেয়নি কোনো হাসপাতাল। বাবার হার্টের সমস্যা ছিল। হাসপাতালে ভর্তি করতে পারলে হয়তো বেঁচে যেতেন। কিন্তু কোনো লবিংই কাজে দেয়নি। চিকিৎসকদের করোনাভীতির কারণে মাও পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাননি।’
তাসলিমা জানান, তাঁদের মা এতটাই অসুস্থ ছিলেন যে তাঁর পাশ থেকে বাবার লাশ নেওয়ার সময়ও তিনি কিছুই বুঝতে পারেননি। তাসলিমা বলেন, ‘আমার বাবা ও মায়ের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল, তেমন সম্পর্ক সচরাচর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কমই দেখা যায়। দুজনই চাইতেন একজন আরেকজনের আগে মারা যেতে, যাতে প্রিয়জনের লাশ দেখতে না হয়। আর এই দুজন মারাও গেলেন মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে উম্মে তানজিলা চৌধুরীর (মুনিয়া) স্বামী ধ্রুব রফিক শ্বশুরকে নিয়ে লিখেছেন, ‘একজন কিংবদন্তি পিতার অপ্রত্যাশিত বাধ্যতামূলক চিরপ্রস্থান...যে চট্টগ্রাম শহরে চিকিৎসা বাণিজ্যে ভরপুর সেখানে টাকা দিয়েও কোথাও ভর্তি করান যায়নি। ওনার ছেলে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে গেলেও সেখানে তাঁকে বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে অনেক রাতে আবার বাসায় ফিরতে হয়েছিল। আরেক দিন ন্যাশনাল হাসপাতাল, সর্বশেষ মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, ফিল্ড হাসপাতাল ইত্যাদি ঘুরে হতাশ হয়ে বাসায় ফিরে আসেন। রাতে বিছানায় হাসিমুখে চিরপ্রস্থান করেন! এ হাসি আমাদের এ অব্যবস্থাপনা দেখে!’