ভারত, আমিরাত, জর্ডান হয়ে লিবিয়া পৌঁছেছিলেন তাঁরা
ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান হয়ে নিহত ও আহত বাংলাদেশিরা লিবিয়ায় পৌঁছেছিলেন। সেখান থেকে নৌকায় ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তাঁদের পৌঁছানোর কথা ছিল ইতালিতে।
তবে ইতালিতে পৌঁছানোর আগেই গত ২৮ মে লিবিয়ার মিসদাহ উপশহরের মরুভূমিতে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় মারাত্মকভাবে আহত হন আরও অন্তত ১১ জন। এখনো নিখোঁজ আছেন দুজন।
পুলিশ বলছে, পাচারকারীরা বাংলাদেশিদের যে ক্যাম্পে আটকে রেখেছিল, সেখানে জিম্মি করা হয়েছিল সুদানের কিছু লোকজনকেও। নির্যাতন সইতে না পেরে সুদানের লোকজন স্থানীয় একজন পাচারকারীকে হত্যা করে। এরপরই একে একে হত্যা করা হয় ২৬ বাংলাদেশি ও সুদানের কয়েকজনকে।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ এসব কথা জানতে পেরেছে।
লিবিয়ায় হত্যা ও মানবপাচারের ঘটনায় ঢাকার পল্টন, তেজগাঁও ও বনানী এবং ঢাকার বাইরে মাদারীপুর ও কিশোরগঞ্জে মামলা হয়েছে। এসব মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), ছায়া তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। গতকাল আলাদা দুটি সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি নতুন করে তিনজন ও ডিবি ছয়জনকে গ্রেপ্তারের খবর দিয়েছে।
পুলিশ বলছে বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
সিআইডি যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা হলো সোহাগ হোসেন, খালিদ চৌধুরী ও মোছা. সানজিদা। পল্টন ও বনানীতে বাদী হয়ে সিআইডির কর্মকর্তারা যে মামলা দায়ের করেছেন সেখানে পুরানা পল্টনের রুজভেল্ট ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও বনানীর বেঙ্গল টাইগার ওভারসিজ প্রাইভেট লিমিটেডের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যদিকে ডিবি যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে তাঁরা হলেন, বাদশা মিয়া, জাহাঙ্গীর মিয়া, আকবর আলী, সুজন, নাজমুল হাসান ও লিয়াকত শেখ ওরফে লিপু। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে চারটি পাসপোর্ট, দুইটি মোবাইল ফোন ও টাকার হিসাব সম্মিলিত দুইটি নোটবুক উদ্ধার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
আদালতে জবানবন্দি:
ডিবির হাতে গ্রেপ্তার মো. সুজন মিয়া আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পাচারের ক্ষেত্রে কোন কোন রুট ব্যবহার করেছে তারও বিবরণ দিয়েছে সুজন।
তিনি জানান ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইতালিতে ছিলেন। পরে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি জাফর, কাউসার ও শাকিলের মাধ্যমে তাঁর ছোট ভাই সজীবকে লিবিয়া পাঠান। সুজন তাঁর ছোট ভাইয়ের সহায়তায় নিজেদের ও পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজনকে বিদেশে পাঠাতেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে তিনি প্রথমে ৫০ হাজার টাকা ও পাসপোর্ট নিয়ে সজীবের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।
সুজন বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের ঢাকায় এনে রাখেন। পরে ঢাকা থেকে তাঁদের চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম থেকে তাঁরা ভারত হয়ে দুবাইতে পৌঁছান।
সেখান থেকে তাঁদের তুলে নেন আফ্রিন আহমেদ নামে এক ব্যক্তি। জামাকাপড় বদলে সবাইকে নীল রং এর টি শার্ট পরতে দেন। দুবাই থেকে তাঁদের পাঠানো হয় আম্মানে। সবাইকে দ্বিতীয় দফা জামাকাপড় পাল্টে টিয়া রঙের টিশার্ট পরিয়ে পাঠানো হয় লিবিয়ায়।
আম্মান থেকে তাঁদের লিবিয়ায় পাঠান জর্ডানের এক ব্যক্তি। সুজন তাঁর নাম বলতে পারেননি। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর তাঁদের সাদা-কালো টিশার্ট পরিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।
এই কাজে যুক্ত ছিলেন সুজনের ভাই সজীব, মানিক, জাফর, তানজিরুল ও লিবিয় পাচারকারীরা। সেখানে আটকে রেখে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। টাকা আদায় করে পরে নৌকায় ইতালিতে পাঠানোর কথা ছিল।
সুজনের জবানবন্দির ভিত্তিতে মো. হজরত আলী ও নাজমুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিবি যা বলছে :
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মানব পাচারের ঘটনায় ভিকটিমদের ভারত, দুবাই, মিশর হয়ে লিবিয়াতে পাচার করার পরিকল্পনা হয়। গত ৭ জুন গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক টিম রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করে। তিনি বলেন, লিবিয়ার বিভিন্ন এস্টেটে কাজ ও লিবিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি দালালেরা অন এ্যারাইভাল ও ভিজিট ভিসার মাধ্যমে লোকজনকে লিবিয়ায় পাচার করে। এরপর লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করে। তাদের কান্নাকাটির অডিও দেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের পাঠায়। কখনো কখনো জিম্মি থাকা ব্যক্তিকে দিয়ে আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফোন করায় ও টাকা দাবি করে।
অনুসন্ধানে ডিবি জেনেছে, লিবিয়ায় নিহতদের মধ্যে মাদারীপুরের সাতজনকে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়াতে আমির হোসেনের কাছে পাচার করে তার ভাই গ্রেপ্তারকৃত আকবর হোসেন।
গ্রেপ্তারকৃত বাদশা মিয়া গত ১৩ বছর ধরে লিবিয়াতে অবস্থান করছিল। লিবিয়ার বেনগাজি, জোয়ারা শহরে তাঁর নিজের ক্যাম্প রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজনকে ফুঁসলিয়ে প্রথমে তিরি লিবিয়ায় তাঁর নিজের ক্যাম্পে রাখে। পরে সেখান থেকে অবৈধভাবে নৌকায় ইতালি পাঠায়।
মাদারীপুরের নিহতদের মধ্যে ৪ জনকে তার ক্যাম্পে আটকে রেখে ত্রিপোলিতে পাচার করার একপর্যায়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।
আবদুল বাতেন বলেন, গ্রেপ্তারকৃত জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা থেকে বেনগাজিতে যোগাযোগ রাখতেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল পাসপোর্ট স্ক্যান করে দুবাই এবং লিবিয়াতে পাঠিয়ে টুরিস্ট ভিসা, অন অ্যারাইভাল মোয়াফাকা সংগ্রহ করা ও বেনগাজির ক্যাম্প ঠিক করা। গ্রেপ্তারকৃত সুজন ভিকটিম ইছার উদ্দিন, বিজয় ও মো. সজলদের লিবিয়ায় পাঠায়।
২৮ মে লিবিয়ায় গুরুতর আহত অবস্থায় মো. সজলকে পাওয়া গেলেও, মো. বিজয় ও ইছার উদ্দিনের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।