বাসের ভাড়া ৮০ শতাংশ বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মতো পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত। তবে এর জন্য ৮০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কতটা যৌক্তিক, এই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, এক ঘণ্টার বৈঠকে চুলচেরা ব্যয় বিশ্লেষণ না করেই ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বাড়তি ভাড়ার বিষয়টি আপৎকালীন সিদ্ধান্ত। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ভাড়া কমবে—এই নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউ। ফলে সার্বিক বিবেচনায় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় পরিবহনমালিকদের দাবির মুখে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই বাড়তি ভাড়ার বোঝা যাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
সরকার সীমিত আকারে গণপরিবহন চালুর ঘোষণা দেওয়ার পর বাস-মিনিবাসে ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এ পরিস্থিতিতে পরিবহনমালিকেরা লোকসান এড়াতে ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজ সকালে বিআরটিএ কার্যালয়ে সংস্থাটির স্থায়ী ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটির ঘণ্টাখানেকের বৈঠকে রাজধানী ঢাকাসহ দূরপাল্লার পথের বাসের ভাড়া ৮০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ১ জুন থেকে তা কার্যকর হবে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে কম যাত্রী পরিবহন করতে হবে, এই অজুহাতে লঞ্চেরও ভাড়া বাড়ানোর দাবি তুলেছিলেন লঞ্চমালিকেরা। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দেয়।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্র বলছে, লঞ্চমালিকেরা কম যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চালাচ্ছেন, তাঁরা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিনিয়োগ করছেন—এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি আসে। হুট করে ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হলো আর তাঁরা গাদাগাদি করে যাত্রী তুললে তো কোনো উদ্দেশ্যই পূরণ হবে না।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ পরিবহনমালিকদের চাপে শুরুতেই ভাড়া বাড়িয়ে দিয়ে সেই পর্যবেক্ষণের সুযোগটা হাতছাড়া করেছে বলে মনে করছেন খোদ মন্ত্রণালয়েরই কোনো কোনো কর্মকর্তা।
সরকারের সংস্থা রেল কর্তৃপক্ষ প্রায় ৩০০ ট্রেনের মধ্যে ১৯ জোড়া ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব ট্রেনের আবার ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা রাখা হবে। পাশাপাশি ট্রেন জীবাণুমুক্ত করাসহ স্বাস্থ্যবিধির প্রায় সবই মানার মূল দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু তারা ভাড়া না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ সূত্র বলছে, করোনা পরিস্থিতির আগেই ভাড়া বাড়ানোর একটা প্রস্তাব তৈরির জন্য পরিবহনমালিকেরা চাপ দিয়ে আসছিলেন। বিআরটিএ ৪০ শতাংশ বাড়ানোর একটা খসড়াও তৈরি করেছিল। কিন্তু পরিবহন খাতে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার কারণে সরকার তা প্রকাশ করেনি। এখন করোনা পরিস্থিতির সুযোগে ভাড়া দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করেন, এমন ব্যক্তিদের মতে, পরিবহনমালিকেরা স্বাস্থ্যবিধি মানতে টাকা খরচ করছেন, ৫০ শতাংশ আসন সত্যি ফাঁকা রাখা হচ্ছে—এটা নিশ্চিত হয়েই ভাড়া বাড়ানো যেত। এ ছাড়া বাসের ভাড়া বাড়ানোর আগে ব্যয় বিশ্লেষণ করার রীতি আছে। সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে ভাড়া কম বাড়িয়ে যাত্রীদের ওপর চাপ কমানো যেত। এখন যে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, সেটার চেয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হতে পারে। কারণ, অতীতেও তা-ই হয়েছে। এ ছাড়া পরিবহন খাতে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয়। এগুলো বন্ধ না করা গেলে ভাড়া বাড়িয়ে লাভ হবে না। কারণ, লাভের গুড় চাঁদাবাজেরাই খেয়ে ফেলছে।
জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (প্রশাসন) ইউসুফ আলী মোল্লা (চেয়ারম্যানের দায়িত্বে) প্রথম আলোকে বলেন, ৫০ শতাংশ যাত্রী কম পরিবহন এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিবহনমালিকেরা ব্যয় করবেন—এই বিবেচনায় ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। মালিকেরা তা মানছেন কি না, সেটা দেখে ভাড়া বাড়ানো যেত কি না, এমন প্রশ্নের তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতির পর ভাড়া কীভাবে আগের জায়গায় নিয়ে আসা হবে, সেটিও পরিষ্কার করেননি তিনি। শুধু বলেছেন, যে নিয়ম অনুযায়ী তো আগের জায়গায় এমনিতেই চলে আসার কথা।
৮০ শতাংশ বৃদ্ধি কতটা যৌক্তিক
বিআরটিএ সূত্র বলছে, বাস-মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাস ক্রয়, ব্যাংকঋণ, জ্বালানি খরচসহ ২০ ধরনের ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়। কোনো একটা উপকরণের ব্যয় বাড়লেই ভাড়া বাড়ানোর প্রশ্ন আসে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কোনো কিছুর ব্যয় বাড়েনি। ফলে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে শুধু যাত্রী কম বহনের আশ্বাসের ভিত্তিতে।
বর্তমানে ঢাকায় কিলোমিটারপ্রতি মিনিবাসে ১ টাকা ৬০ পয়সা এবং বড় বাসে ১ টাকা ৭০ পয়সা ভাড়া নির্ধারিত আছে। দূরপাল্লার পথে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ১ টাকা ৪২ পয়সা। ঢাকায় সর্বনিম্ন ভাড়া আছে মিনিবাসে ৫ এবং বড় বাসে ৭ টাকা। আর দূরপাল্লার পথে ফেরি বা সেতুর টোল যুক্ত হয়।
ঢাকায় প্রতিটি বাস-মিনিবাসে ২০ শতাংশ এবং দূরপাল্লার পথে ১০ শতাংশ আসন ফাঁকা থাকবে—এটা ধরে নিয়েই এই ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে ঢাকার বাসে এমনিতেই ২০ শতাংশ এবং দূরপাল্লার বাসে ১০ শতাংশ আসন ফাঁকা থাকার কথা।
আইন অনুসারে মিনিবাসের আসন ৩০টি। আর বড় বাসের ৫১টি। ঢাকার প্রতিটি বাস-মিনিবাসে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত আসন বাড়িয়ে নিয়েছেন মালিকেরা। অর্থাৎ সরকার যে হিসাব করে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, তাতে বিদ্যমান বাস-মিনিবাসের ৫০ শতাংশ ফাঁকা রাখলেও লোকসান হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে পরিবহনমালিকেরা ‘সিটিং সার্ভিস’সহ নানা নামে আগে থেকেই শতভাগ বা এরও বেশি ভাড়া আদায় করে আসছেন। নতুন করে ৮০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া সেই আগের বাড়তি ভাড়ার সঙ্গেই যুক্ত করে আদায় করবেন পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা।
অন্যদিকে দূরপাল্লার বাসের মধ্যে সরকার শুধু শীতাতপনিয়ন্ত্রণবিহীন (নন-এসি) বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। বিলাসবহুল ও এসি বাসের ভাড়া মালিকেরা নিজেরাই ঠিক করে থাকেন। অর্থাৎ বাজারে চাহিদা-জোগানের ওপর ভাড়া নির্ভরশীল। এসব বাসের ভাড়া আগে থেকেই এত বেশি যে কখনো কখনো ২০-৩০ শতাংশ আসন ফাঁকা থাকলেও তাঁদের লোকসান গুনতে হয় না। সবার জন্য ৮০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। এ ছাড়া দূরপাল্লার পথের নন-এসি বাসগুলোও সব সময় সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করে থাকে। ফলে এখন ৮০ শতাংশ বাড়তি মানে হচ্ছে আগের বাড়তি ভাড়ার ওপর আরও ভাড়া বাড়ানো।
আসলে লাভ খাচ্ছে `পিঁপড়ায়'
পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক, বিআরটিএ কর্মকর্তা এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসলে পরিবহন খাতের মালিকেরা যে ভাড়া আদায় করছেন, তা দিয়েই লোকসান এড়ানো সম্ভব। কিন্তু পদে পদে চাঁদাবাজি তাঁদের লাভ খেয়ে ফেলছে। এ জন্য যতই ভাড়া বাড়ানো হোক না কেন, সাধারণ পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের খুব একটা লাভ নেই। চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ভাড়া না বাড়িয়ে লাভ করা সম্ভব।
রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে ছয় হাজারের মতো বাস-মিনিবাস চলাচল করে। এগুলোর মালিক প্রায় দুই হাজার। কোনো কোনো মালিকের একটিমাত্র বাস কিংবা মিনিবাস আছে, যাঁদের অনেকে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী। এই দিয়েই সংসার চলে। সব বাস চলাচল করে প্রায় পৌনে দুই শ কোম্পানির অধীনে।
এই কোম্পানিগুলোর এমডি বা চেয়ারম্যানের বেশির ভাগই সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা। কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আত্মীয়। তাঁরা একটি বা খুব কমসংখ্যক বাস নামিয়ে কোম্পানির সর্বেসর্বা হয়ে যান। এরপর সাধারণ মালিকেরা তাঁদের অধীনে বাস চালাতে দেন। বিনিময়ে কোম্পানিকে দৈনিক ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এটাকে জিপি বা গেট পাস বলা হয়।
পরিবহন সূত্রগুলো বলছে, এই চাঁদার কিছু অংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেছনে ব্যয় হয়। স্থানে স্থানে কোম্পানির টিকিট পরীক্ষা করার যে লোক থাকেন, তাঁদের পেছনে কিছু খরচ হয়। কিছুটা অফিস খরচ। সিংহভাগই কোম্পানির প্রভাবশালী উদ্যোক্তাদের পকেটে চলে যায়।
ঢাকায় সাংসদ ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের পরিবারের সার্বিক পরিবহনের বাস চলে কয়েকটি পথে। তাঁর ভাই আজিজুর রহমান খান কোম্পানির প্রধান। নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমানের আছে জেড এন করপোরেশন। সাংসদ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ বিহঙ্গ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। যুবলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খান নিখিলের নামে আছে চলন পরিবহন। এর বাইরে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন নেতা ও কাউন্সিলরদের অন্তত ৩০ জনের পরিবহন কোম্পানি আছে।
এ ছাড়া রাজধানী ও দূরপাল্লার প্রতিটি পরিবহন থেকে দৈনিক ৭০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। ৪০ টাকা যায় মালিক সমিতির কাছে। ৩০ টাকা শ্রমিক ইউনিয়নের। সারা দেশে শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান। আর মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান আর মহাসচিব আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, জিপির নামে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। তবে মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে খুব বেশি চাঁদাবাজি হয় না। সংগঠন চালাতে যে অর্থের প্রয়োজন হয়, সেটা তাঁরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছেন। এই হার হবে কম, যৌক্তিক। অদূর ভবিষ্যতে পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে বলে তিনি দাবি করেন।
প্রতিটি জেলা পর্যায়েও পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের সংগঠন আছে। এসব সংগঠনের শীর্ষ পদ এখন আওয়ামী লীগের নেতা বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের দখলে। কোনো জেলা কমিটির সদস্য হয়ে বাস নামাতে হলে ২ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় বলে পরিবহন সূত্রগুলো বলছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধ করা গেলে পরিবহনের ভাড়ানৈরাজ্যসহ সব বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার করোনা পরিস্থিতিতে অন্তত এই কাজটি করে দেখাতে পারে। আর এখন ভাড়া না বাড়িয়ে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে দিতে পারত সরকার। এখন যে ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে, তা আর কোনো দিন কমানো যাবে না।