চিকিৎসক কামরুল ও টেকনোলজিস্ট বিভূতির প্রশংসায় সবাই
করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগে সেবা দেওয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় বরগুনার চিকিৎসক কামরুল আজাদ (৪১) ও বরিশালের টেকনোলজিস্ট বিভূতিভূষণ হালদারের (৩০) প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। প্রথম আলো অনলাইনে তাদের দুজনকে নিয়ে করোনার দিনে টানা এক মাস চিকিৎসা দিচ্ছেন কামরুল এবং করোনার দিনে 'সত্যিকারের নায়ক' বিভূতিভূষণ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেগুলো সবার নজর কাড়ে।
বরগুনা জেলারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কামরুল আজাদকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি লিখেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট বিভূতিভূষণ হালদারকে সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে ও উপহার দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে বরিশালের প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ। গতকাল রোববার বিকেলে জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান ও নগর পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন ফুল, ফল ও নগদ অর্থ পাঠিয়ে বিভূতিকে শুভেচ্ছা জানান।
দুদক চেয়ারম্যান চিকিৎসক কামরুলকে লিখেছেন, 'বরগুনা জেনারেল হাসপাতলের সীমিত অবকাঠামোর মধ্যে আপনি ও আপনার সহযোগীদের কার্যক্রম অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ও প্রশংসনীয়। এই মহাদুর্যোগের সময় আপনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে মানুষের সেবায় এগিয়ে এসে অনুকরণীয় আদর্শের সৃষ্টি করেছেন। মানবকল্যাণে আপনি যে কাজ করেছেন, সে জন্য আপনার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা।'
চিকিৎসক কামরুল আজাদ তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, 'আমি বিবেকের তাড়নায় দেশের জন্য এই যুদ্ধ করছি। প্রথম আলো আমার এসব কাজ তুলে ধরেছে। এমন ঘটনায় আমাদের সব চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী অনুপ্রাণিত হবেন। দুদকের চেয়ারম্যানকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।'
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, কোনো চিকিৎসক সাত দিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় থাকলে পরের ১৪ দিন তাঁকে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। কিন্তু এমনটা করতে পারছেন না চিকিৎসক কামরুল আজাদ। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের ৫০ শয্যার করোনা ইউনিটের দায়িত্ব তাঁর। তিনি মেডিসিন বিভাগের একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তিনি কোয়ারেন্টিনে গেলে রোগীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হবেন ভেবে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। নিজের ও সহকর্মীদের কাছ থেকে টাকা তুলে করোনা ইউনিটকে সেবা দেওয়ার উপযোগী করেছেন। নিজের অর্থে তাঁবু খাঁটিয়ে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগী ও সাধারণ রোগীদের বাছাই করার জন্য রোগী শনাক্তকরণ জোন খুলেছেন। নিজের টাকায় রোগীদের পুষ্টিকর খাবার কিনে দিচ্ছেন। রোগীর মনোবল বাড়াতে কাউন্সিলিং করছেন। আবার হাসপাতালের অন্য চিকিৎসকদের করোনা বিষয়ে প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন কামরুল আজাদ।
প্রথম আলোতে খবর প্রকাশের পরের দিন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট বিভূতিভূষণ হালদারের থাকার সমস্যার সমাধান করে কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে বরিশাল নগরের একটি অভিজাত হোটেলে তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। গতকাল বিভূতিকে নগর পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিনের পক্ষ থেকে ফল, নগদ অর্থ ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই, হ্যান্ড স্যানেটাইজার, হ্যান্ড গ্লাভস) পৌঁছে দেওয়া হয়। এর আগে জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমানের পক্ষ থেকে ফল ও প্রাইজবন্ড প্রণোদনা হিসেবে বিভূতিভূষণের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এমন প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় বিভূতিভূষণ বলেন, 'প্রথম আলোর মাধ্যমে সারা দেশ ও বিশ্বের মানুষ আমার কাজের কথা জানতে পেরেছেন। প্রথম আলোর কাছে আমি ও আমার পরিবার কৃতজ্ঞ। আমি কোনো প্রণোদনা বা পুরস্কারের জন্য এই কাজ করিনি। মানবিক দায়িত্বের জায়গা থেকে জীবনের ঝুঁকি জেনেও এই কাজে নেমেছি।'
বরিশাল শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ২৯ মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা শুরু হয়। ওই দিন থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজ করছেন টেকনোলজিস্ট বিভূতিভূষণ হালদার। সেই থেকে গতকাল পর্যন্ত একাই করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২৭১ রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেছেন তিনি। এই কাজে তাঁর সঙ্গে আরও চারজনকে পালা করে দায়িত্ব দেওয়া হলেও নানা অজুহাতে তাঁরা নাম কাটিয়ে ফেলেন। এরপর বিভূতি একাই কাজটা চালিয়ে যাচ্ছেন। বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা তাই তাঁকে 'সত্যিকারের নায়ক' বলছেন।
বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, 'বিভূতিভূষণের এই সাহসিকতা, এমন ত্যাগ আমাদের জন্য এক অনন্য উদাহরণ। এমন এক সাহসী যোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এই দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই আমরা তাঁকে প্রণোদনা দিয়েছি, যাতে তিনি উৎসাহিত হন।'