করোনার দিনে টানা এক মাস চিকিৎসা দিচ্ছেন কামরুল
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, কোনো চিকিৎসক সাত দিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দিলে তাঁকে পরের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। কিন্তু এমনটা করতে পারছেন না চিকিৎসক কামরুল আজাদ (৪১)। তিনি বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। গত ২৫ মার্চ থেকে তিনি এক দিনের জন্যও কোয়ারেন্টিনে যেতে পারেননি। পুরোটা সময় তিনি চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের ৫০ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ডের দায়িত্ব কামরুল আজাদের ওপর। করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে এ পর্যন্ত এখানে আসা ৬১ জনকে চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি। তাঁদের মধ্যে ১০ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার তাঁর তত্ত্বাবধানে এখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন ২১ জন। হাসপাতালে বক্ষব্যাধি ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পদ শূন্য থাকায় তাঁকেই সামলাতে হচ্ছে করোনা রোগীদের।
বরগুনা জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ও জ্বর–সর্দির মতো উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের চিকিৎসায় কামরুল আজাদই একমাত্র ভরসা। ফলে সারা দিন ডিউটি করে নতুন রোগী এলে রাত ১২টায়ও তাঁকে ছুটতে হচ্ছে হাসপাতালে। পাশাপাশি মেডিসিন ওয়ার্ডের নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা, জেলার অন্য হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন তিনি। চীনফেরত এক ছাত্রের করোনা উপসর্গের চিকিৎসা দিতে গিয়ে বরিশাল বিভাগে তিনিই প্রথম আইসোলেশন ওয়ার্ড চালু করেন।
শুধু চিকিৎসাই নয়; নিজের বেতনের টাকায় রোগীদের পুষ্টিকর খাবার কিনে দেওয়ার চেষ্টা করেন কামরুল আজাদ। চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীদের মানসিক শক্তি জোগাতে তিনি কাউন্সেলিং করছেন। হাসপাতাল চত্বরে নিজের অর্থে তাঁবু খাঁটিয়ে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগী ও সাধারণ রোগীদের বাছাই করার জন্য দুই কক্ষের একটি রোগী শনাক্তকরণ জোনও খুলেছেন তিনি।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সোহরাফ হোসেন গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘একজন এফসিফিএস চিকিৎসক হয়েও তিনি যেভাবে একটানা কাজ করছেন, সেটা সারা দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য অনুকরণীয়। আমরা উনাকে বারবার বলি, আপনি সুস্থ থাকার জন্য বিশ্রাম নিন। তিনি বলেন, আমি বিশ্রামে গেলে এই রোগীদের কী হবে? এই জেলায় প্রশিক্ষিত করোনা চিকিৎসক হিসেবে তিনিই একমাত্র ভরসা। তাঁকে নিয়ে আমরা গর্বিত।’
হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এক রোগী মুঠোফোনে বললেন, ‘কামরুল স্যারকে দেখলে মনে সাহস পাই। তিনি ডাক্তারদের ব্যাপারে মানুষের প্রচলিত ধারণা বদলে দিয়েছেন।’
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি হাসপাতালে করোনা ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ আসে। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে সে রকম অবকাঠামো ছিল না। এরই মধ্যে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চীনফেরত এক ছাত্র বরগুনায় আসেন করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে। তখন করোনা চিকিৎসায় কোনো চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ ছিল না। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় কেউ এগিয়ে আসার সাহস দেখাননি। তখন কামরুল আজাদ এগিয়ে এলেন। হাসপাতালের সীমিত অবকাঠামোর মধ্যে ওই ছাত্রকে আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা করেন। ইন্টারনেট ঘেঁটে তিনি ওই ছাত্রকে চিকিৎসাসেবা দেন। ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) ওই ছাত্রের নমুনা পরীক্ষায় করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। কিন্তু তিনি তাঁকে ১৪ দিন এখানে রেখে চিকিৎসা দেন।
মার্চের মাঝামঝি হাসপাতালের ২৫০ শয্যার নির্মাণাধীন নতুন ভবনে করোনা ইউনিট খোলা হলো। কিন্তু এই ভবনের দরজা–জানালা লাগানো ছাড়া আর সব কাজ বাকি ছিল। কামরুল নিজে এবং হাসপাতালের অন্যদের কাছ থেকে অর্থ তুলে নিজের মতো করে সাজালেন করোনা ইউনিট। ১৯ মার্চ ঢাকায় এক দিনের করোনা প্রশিক্ষণের জন্য একজন চিকিৎসককে ডাকা হলো। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সব চিকিৎসককে নিয়ে বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন, চিকিৎসক কামরুলই যাবেন।
এই বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার কামরুল আজাদ বলেন, ‘কিছু না ভেবেই হ্যাঁ বললাম। পরিবারের সবাই ঢাকায় থাকেন। সাত বছর বয়সী একমাত্র ছেলে, স্ত্রী, উচ্চ মাত্রার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বাবা-মা ও ক্যানসার আক্রান্ত শাশুড়ি—সবার দেখভালের দায়িত্ব আমার। দেশের দুর্যোগে পরিবারের কথা ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিতে মন সায় দিল না।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্ত্রী নাইয়ার আফরিনকে জানাই। ও প্রথমে কিছুটা নীরব ছিল। এরপর বলল, দেশের মানুষের টাকায় তুমি পড়াশোনা করে চিকিৎসক হয়েছ। এর বদৌলতে আমরা মর্যাদাপূর্ণ একটা জীবন পেয়েছি। দুর্দিনে তুমি তাদের পাশে থাকো। সংসার, সন্তান, পরিবার আমি সামলে নেব।’
১৯ মার্চ এক দিনের করোনা প্রশিক্ষণে ঢাকায় যান কামরুল আজাদ। প্রশিক্ষণ শেষে রাতে ঢাকার বাসায় গিয়ে প্রচণ্ড জ্বরে পড়েন। পরের দিন আইইডিসিআরে নমুনা দেন। করোনা নেগেটিভ আসে। তিনি বরগুনায় চলে আসেন। আসার সময় ছেলেটা জড়িয়ে ধরে তাঁকে বলছিল, ‘বাবা তুমি কবে আসবে?’ তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।
২৫ মার্চ থেকে কামরুল আজাদ বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে কাজ শুরু করেন। করোনার উপসর্গ নিয়ে অনেকেই হাসপাতালে আসছেন। সবাই আতঙ্কিত। তিন দিনের মাথায় খবর পেলেন, তাঁর বাচ্চার প্রচণ্ড জ্বর। পরে স্ত্রীরও জ্বরে পড়েন। ঘরে তিনজন অসুস্থ বয়স্ক মানুষ। কে কাকে দেখবে, সেবা করবে; ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে যায় তাঁর। কামরুল বললেন, ‘তখন ইচ্ছে করছিল সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় পরিবারের কাছে ছুটে যাই। কিন্তু আমি চলে গেলে রোগীদের কী হবে, এই ভাবনা আমাকে আটকে রাখল।’
কামরুল বললেন, ‘সারা দিন ভালো থাকি। রোগীদের চিকিৎসা দিই, সাহস দিই। গভীর রাতে যখন রুমে ফিরি, তখন একা লাগে। সবার মুখগুলো চোখের সামনে ভাসে। পড়াশোনা আর লেখালেখি করে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে আবেগকে স্থান দিতে নেই।’ তাঁর ভাষায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর জন্য আসলে কোনো চিকিৎসা নেই। এর চিকিৎসা হচ্ছে রোগীকে যত্ন করা আর সাহস জোগানো। করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য একজন মনোরোগ চিকিৎসক থাকেন। এখানে তা নেই।