পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল খুনি মাজেদের
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি আবদুল মাজেদ ঢাকায় বসবাস করা পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। এক চিকিৎসক কন্যা ও চট্টগ্রামে বসবাস করা ভাইকে প্রায়ই ফোন করতেন তিনি। কলকাতার সূত্রগুলোর ধারণা, এই ফোনালাপকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা কলকাতায় মাজেদের অবস্থান শনাক্ত করে। তবে মাজেদ কীভাবে ঢাকায় এলেন, সে ব্যাপারে কেউ কিছু বলছে না। সাবেক কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদেরা মনে করছেন, ভারত সরকারই মাজেদকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিয়েছে।
৭ এপ্রিল মাজেদকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। আদালতে দেওয়া পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ এপ্রিল দিবাগত রাতে তিনি রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে থেকে রিকশায় করে সন্দেহজনকভাবে যাচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁর কথাবার্তা অসংলগ্ন মনে হয়। জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তিনি নিজের পরিচয় জানান। তবে পরদিন (৭ এপ্রিল) রাতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তাঁর বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মাজেদকে মিরপুর সাড়ে ১১ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
১২ এপ্রিল রাত ১২টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাঁকে দাফন করা হয় নারায়ণগঞ্জের একটি গ্রামে। তবে দাফনের সময় পরিবারের কেউ সেখানে ছিলেন না। ফাঁসি কার্যকরের পর থেকে মাজেদের পরিবারের সবাই ফোন বন্ধ রেখেছেন। তাঁরা কারও সঙ্গে কথা বলছেন না।
ঢাকায় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, চার মেয়ে ও এক ছেলে নিয়েই মাজেদের পরিবার। দুই মেয়ে ও এক ছেলে বিদেশে থাকেন। ঢাকায় চিকিৎসক স্ত্রী সালেহা বেগম এবং দুই মেয়ে ফাতেমা সিদ্দিকা ও মাসুমা সিদ্দিকা থাকেন। দুই মেয়েও চিকিৎসক। ফাতেমা সিদ্দিকার সঙ্গে মাজেদ নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। মাজেদের ভাই শাহজাহান চৌধুরী থাকেন চট্টগ্রামে, তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল।
ঢাকায় গ্রেপ্তারের পর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হেমায়েত উদ্দিন খানের কাছে নিজের বিদেশে অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন মাজেদ। তিনি বলেছিলেন, ২২-২৩ বছর ধরে তিনি কলকাতাতেই ছিলেন। সেখান থেকে গত মাসের (মার্চ) মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে আসেন। এরপর তিনি ঢাকাতেই ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার খুন করে ফারুক-রশিদের সঙ্গে মাজেদও দেশ ছাড়েন। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে দায়িত্ব পালন শেষে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগও দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত বিজয় দেখে বঙ্গবন্ধুর খুনি ডালিম ও রশীদের সঙ্গে তিনি পালিয়ে যান। এ সময় তিনি প্রথমে ভারত, সেখান থেকে পাকিস্তান হয়ে লিবিয়ায় যান। পরে আবার ভারতে ফিরে আসেন। তবে ঠিক কবে থেকে ভারতে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন, তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি।
মাজেদের কলকাতায় অবস্থান নিয়ে তিন পর্বের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে কলকাতার বাংলা দৈনিক বর্তমান। সেই পত্রিকার সাংবাদিক সুজিত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার পর তিনি আর ফিরে আসেননি। তাঁর ধারণা, ২২ ফেব্রুয়ারিই মাজেদের ভারতে পলাতক জীবনের শেষ দিন।
সুজিত বলেন, মাজেদ কলকাতায় দুটি বাড়িতে থাকতেন। একটি হলো পার্কস্ট্রিটে, অন্যটি তালতলায়। পার্কস্ট্রিটের বাড়িতে তিনি ১০ বছর ধরে থাকতেন। তালতলায় ছিলেন ৯ বছর। পার্কস্ট্রিটের বাড়ি থেকেই ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার পর হাসপাতালের উদ্দেশে বের হন মাজেদ। প্রথমে যান স্থানীয় একটি ফার্মেসিতে। এরপর রিপন স্ট্রিটের দিকে মুখ করে হাঁটতে থাকেন। তখন থেকেই তাঁকে অনুসরণ করতে থাকেন দুই ব্যক্তি। ওই এলাকার একটি সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, বাড়ির বাইরে দুজন তাঁর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁরা সেখান থেকে মাজেদকে অনুসরণ করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তাঁদের সঙ্গে আরও দুজন যুক্ত হন। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ধরে রাস্তা পেরিয়ে এজেসি বোস রোডে আসেন মাজেদ। ওই সময় অনুসরণকারী চারজনকে প্রথম মাজেদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। মৌলালির দিক থেকে আসা সল্টলেক-সাঁতরাগাছি রুটের একটি বাসে চড়ে বসেন মাজেদ। অনুসরণকারী চারজনও বাসটিতে ওঠেন। এরপর আর কোনো ফুটেজ নেই। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বাসস্টপেজ থেকে কলকাতার পিজি হাসপাতাল পর্যন্ত কোথাও তাঁকে নামতে দেখা যায়নি। মাজেদের মোবাইল ফোনের সর্বশেষ টাওয়ার লোকেশন ছিল মালদহ জেলা। কলকাতার লোকজনের ধারণা, তাঁকে অনেক ঘুরিয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে ওই চারজন। একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ওই সময় ভারতীয় গোয়েন্দারা তাঁকে আটক করে হেফাজতে নেন।
বর্তমান–এর প্রতিবেদনে বলা হয়, কলকাতায় থাকার সময় ২০১২ সালে ভারতের ভোটার আইডি কার্ড করেন মাজেদ। এরপর ২০১৭ সালে তিনি ভারতীয় পাসপোর্ট নেন। ভারতীয় পাসপোর্টে নাম ছিল আহমদ আলী। ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল। এতে মাজেদের জন্ম উল্লেখ করা হয়েছে কলকাতার হাওড়ায়। আসলে তাঁর জন্মস্থান ভোলার বোরহানউদ্দিন।
>কলকাতার স্ত্রী বললেন, জানতেন না তিনি খুনি। জানলে হয়তো বিয়েই হতো না
কলকাতায় থাকার সময় মাজেদ দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর সেই স্ত্রী পার্কস্ট্রিট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ওই জিডির তদন্তে নেমে মাজেদের ঘর থেকে একটি হাতব্যাগ উদ্ধার করে পুলিশ। ব্যাগে পাসপোর্ট, রেশন কার্ডসহ কিছু কাগজপত্র ছিল।
ব্যাগে এক নারী ও তিনটি শিশুর ছবিও পাওয়া যায়। পুলিশের ধারণা, ওই নারীই সম্ভবত মাজেদের বাংলাদেশের স্ত্রী সালেহা বেগম। মাজেদের কলকাতার স্ত্রী পুলিশকে বলেন, হাতব্যাগটি মাজেদ কাউকে ধরতে দিতেন না। বাড়িতে ঢুকে তিনি ভেতর থেকে গেটে তালা লাগিয়ে দিতেন। কলকাতার পার্কস্ট্রিট এলাকায় তাঁর পরিচিতি ছিল ইংরেজির শিক্ষক আলী আহমদ নামে। এলাকার লোকজন জানতেন, কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পাস করেছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করতেন। এর বাইরে টাকা ধার দিয়ে সুদের ব্যবসাও ছিল। পার্কস্ট্রিটে ভাড়া বাড়িতে থাকলেও তালতলায় একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য ২৫ লাখ টাকায় বায়না করেছিলেন মাজেদ।
‘মাজেদ খুনি, জানতাম না’
কলকাতা থেকে ফোনে মাজেদের দ্বিতীয় স্ত্রী জরিনা বেগমের সঙ্গে এই প্রতিনিধির কথা হয়। এক আইনজীবীর মাধ্যমে আট–নয় বছর আগে মাজেদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সৈয়দা আয়েশা সিদ্দিকা হুমায়রা নামে ছয় বছরের একটি মেয়ে আছে তাঁদের।
জরিনা বলেন, ‘আমার স্বামী বাংলাদেশের এত বড় নেতার খুনি, তা কোনো কালেও জানতে পারিনি। জানলে হয়তো আমাদের বিয়েই হতো না। আমরা জানতাম, তাঁর নাম আহমদ আলী। সেই নামেই বিয়ে হয়েছে।’
মাজেদ গ্রেপ্তার হওয়ার খবর জরিনা প্রথম জানতে পারেন তাঁর ছোট বোনের স্বামী নাজিমুদ্দিন মল্লিক ফেসবুক থেকে। মাজেদের ফাঁসি কার্যকরের ব্যাপারে কলকাতা পুলিশ আপনাকে কিছু জানিয়েছিল কি না, প্রশ্ন করা হলে জরিনা বলেন, ‘পার্কস্ট্রিট থানা মাজেদের ছবি দেখিয়ে আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, তিনি আমার স্বামী কি না। আমি স্বীকার করলে পুলিশ আমার কাছ থেকে লিখে নেয় যে মাজেদ আমার স্বামী এবং বাংলাদেশে তাঁরই ফাঁসি হয়েছে।’
জরিনা বলেন, ‘এর আগে পুলিশ অনেকবার আমাকে ডেকে নিয়ে মাজেদ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। আমি তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না। তিনি চুপচাপ স্বভাবের মানুষ ছিলেন, তেমন কথা বলতেন না। কিছু জানতে চাইলে বকাঝকা করতেন। আমি যতটুকু জানতাম, ততটুকুই পুলিশকে বলেছি।’
জরিনার বোনের স্বামী নাজিমুদ্দিন মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বাগনান থানার কিমসত বামন গ্রামে। সেই গ্রামের পাশে হাক্কানি আঞ্জুমানের একটি দরবার শরিফ আছে। একসময় সেখানে নিয়মিত যেতেন মাজেদ। ওই দরবারের এক ব্যক্তির মাধ্যমে জরিনার সঙ্গে মাজেদের বিয়ে হয়।