বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তান ও অভিভাবকদের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েক গুণ
করোনাভাইরাসের বিস্তারের এই সময়ে অটিস্টিক, ডাউন সিনড্রোম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, সেরিব্রাল পালসিসহ স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের ভোগান্তি বেড়েছে। এই ধরনের শিশু ও ব্যক্তিরা করোনাভাইরাস সম্পর্কে বুঝতে পারছে না, ঘরে থাকা জরুরি, তাও বুঝতে পারছে না। ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে থেকে থেকে অস্থির হয়ে অনেকে নিজের শরীর ক্ষতবিক্ষত করছে বা মা–বাবাকে কামড় বা খামচি দিচ্ছে। জিনিসপত্র ভেঙে ফেলছে।
পাশাপাশি অটিস্টিক, ডাউন সিনড্রোম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, সেরিব্রাল পালসিসহ স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের অভিভাবকদেরও ভোগান্তি বেড়েছে। কাজও বেড়েছে কয়েক গুণ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে দূরে রাখার সংগ্রামের পাশাপাশি অভিভাবকেরা এই সন্তানদের ঘরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটায় উন্নত শহর নিউইয়র্কে অটিস্টিক সন্তানের মা অথবা বাংলাদেশের অটিস্টিক সন্তানের মায়ের মধ্যে এখন আর তেমন কোনো পার্থক্য থাকছে না। সন্তানকে সামলাতে প্রায় একই সংগ্রাম করতে হয়েছে। বেশি আয় করা অভিভাবকদের তুলনায় স্বল্প আয়ের অভিভাবকদের সন্তান নিয়ে বরাবরেই মতোই সংগ্রামটা বেশি করতে হচ্ছে।
তবে এই অভিভাবকেরাই বলছেন, ভোগান্তি বাড়লেও শুধু করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে ঘরে থাকার কারণে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানকে বেশি সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে, সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কটা গভীর হওয়ার পাশাপাশি সন্তানকে ঘরের কাজগুলো হাতে–কলমে শেখানো সম্ভব হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে সন্তানদেরই কাজে লাগবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তির জন্য।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত (কোভিড-১৯) হয়ে আমেরিকায় মৃত মানুষের সংখ্যা ২০ হাজার ও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও ৫ লাখ ছাড়িয়েছে। আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় আছে নিউইয়র্ক। স্কুলশিক্ষক মনিজা রহমান স্বামী ও দুই ছেলেকে নিয়ে নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায় নিজের বাড়িতে গৃহবন্দী আছেন প্রায় এক মাস ধরে। এস্টোরিয়া হলো কুইন্স বোরোর একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। আর কুইন্স হলো দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বে করোনা মহামারির কেন্দ্রস্থল। ১৩ মার্চ থেকে নিউইয়র্ক সিটির সব স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মনিজা রহমান এস্টোরিয়াতে একটি প্রি–স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
মনিজা রহমানের সঙ্গে কথা হয় ফেসবুকের মেসেঞ্জারে। বললেন, ‘বাসা থেকে স্কুলের কাজ করতে হচ্ছে। বড় ছেলে অনলাইনে স্কুলের ক্লাস করছে। ছোট ছেলে দশ বছর বয়সী স্পেশাল নিডস (অটিস্টিক) শিশু সৃজনের করোনা ভাইরাস সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। সামারসহ সারা বছর ওর স্কুল খোলা থাকে। সার্বক্ষণিক একটা রুটিনের মধ্যে থাকে সে। কিন্তু এখন যে শুধু ওর স্কুল বন্ধ তা নয়, ওর দেখাশোনার জন্য বাসায় যে সাহায্যকারী ছিলেন তিনিসহ থেরাপিস্ট ও নার্সের আসাও বন্ধ। বাসার বাইরে যেতে না পারায় সৃজন খুব বিরক্ত।’
মনিজা রহমান বললেন, ‘বারবার জুতা পরে সে বাইরে যেতে চায়। না নিয়ে গেলে রেগে যায়। ওর স্কুলের শিক্ষকেরা গুগলে ওর ক্লাস নেয়,স্কুলের শিক্ষক ও থেরাপিস্টরা মাঝেমধ্যে ফেসটাইমে ফোন করে ওর সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু ছেলের একাজগুলো অপছন্দ। স্কুলের পড়া কেন আইপ্যাডে—এটা ও কোনোভাবে মেনে নিতে পারে না। আসলে কোনো ধরনের পরিবর্তন ওকে ক্ষুব্ধ করে।’
ছেলের খাওয়াদাওয়া প্রসঙ্গে মনিজা রহমান বললেন, ছেলের প্রিয় খাবারের মধ্যে আছে চিপস, চানাচুর ও ফ্রাইড চিকেন। আগে স্কুলে থাকার কারণে সারাক্ষণ এ খাবারগুলো খাওয়ার সুযোগ পেত না। এখন বাসায় থাকায় একটু পরপর খেতে চায়। খাবার দিতে দেরি করলে খেপে যায়। খামচি দেয়, কামড় দেয়, মারে। মনিজা আক্ষেপ করে বললেন, ‘বাবা-মা, ভাইকে মেরে আবার ছেলে উল্টো কাঁদে। কিছুক্ষণ পরে আমাদের জড়িয়ে চুমু খায়। আসলে ও যে একটা খারাপ কাজ করেছে, এটা সে বুঝতে পারে। অনেক সময় হতাশা থেকেও কাজটা করে ও। পানি নিয়ে খেলা করা, বাথরুমে গিয়ে শ্যাম্পু, ফোম নষ্ট করাসহ কাজগুলো করছে বলে সব সময় চোখে চোখে রাখতে হয়।’
জাতিসংঘ ২ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এপ্রিল মাস অটিজম সচেতনতা মাস হিসেবে পালিত হয়। তবে এবার করোনাভাইরাসের বিস্তারে দিবস ও মাস নিয়ে বিশ্বের কোনো দেশেই আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না।
বাংলাদেশের পুরান ঢাকার আরেক মা নাসরিন আহমেদ অটিস্টিক যমজ সন্তান অনন্ত ও দূরন্তকে নিয়ে সংগ্রাম করছেন। করোনাকালে ২০ বছর বয়সী দুই মেয়েকে নিয়ে এই মায়ের সংগ্রামের মাত্রাটা বেড়েছে।
টেলিফোনে নাসরিন আহমেদ কান্নার জন্য কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলেন না। পাঁচ বছর আগে নাসরিন আহমেদের স্বামী মারা গেছেন। স্বামীর রেখে যাওয়া সঞ্চয়পত্র, ব্যাংকে রাখা কিছু টাকা, এক ভাইয়ের সহায়তা, জাকাতের টাকাসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সহায়তা দিয়েই দুই মেয়েকে নিয়ে দিন পার করেন নাসরিন আহমেদ। করোনাভাইরাস বিস্তারে অনেকেই সাহায্য করতে চেয়েও সাহায্য করতে পারেননি। অন্যদিকে দুই মেয়েকে সারাক্ষণ ঘরে রাখাও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। দুই মেয়ে বেশির ভাগ সময়ই অস্থির থাকছেন।
নাসরিন আহমেদ বললেন, ‘আমার মেয়েরা ভালো জামা পরতে চায়। ভালো খাবার খেতে চায়। দুই মেয়ের পিরিয়ড বা মাসিকের সময় দুই প্যাকেট স্যানিটারি প্যাড কিনতে হয়। প্যাড পরিয়ে দেওয়া, কাপড় ধুয়ে দেওয়া সব কাজ করে দিতে হয়। ছবি এঁকে মেয়েরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কারও নিয়েছে। মেয়েরা ভালো গান গায়। কিন্তু গান বা ছবি আঁকার পেছনে খরচ করলে মেয়েদের মুখে খাবার তুলে দিতে কষ্ট হয়। এই কথাগুলো তো আর জনে জনে বলতে পারি না। চাইলেই সবার কাছে হাত পেতে সাহায্য চাইতে পারি না। আমার শরীর ঠিক থাকে না। মাথা কাজ করে না। আমার যে কষ্ট তা বাইরের কেউ তা বুঝতে পারবে না।’
রাজধানীর গোপীবাগের আরেক মা শাফাতুন নেসা। তাঁর ৩২ বছর বয়সী বড় মেয়ে সুমাইয়া সেরিব্রাল পালসির কারণে একা হাঁটতে পারেন না। ওয়াকারের সাহায্যে হাঁটেন। এই মেয়ে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগ থেকে পাস করে বর্তমানে এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানিতে চাকরি করছেন। শাফাতুন নেসা বা তাঁর স্বামী মেয়েকে অফিসে আনা–নেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। শাফাতুন নেসার সংগ্রামের গল্পটার এখানেই ইতি টানা সম্ভব না। তাঁর ২২ বছর বয়সী ছেলে আহমেদ ফাহিম অটিস্টিক। এই ছেলের যখন মন চাইবে বাসা থেকে বের হবেই। করোনাভাইরাসের বিস্তারের এই সময় বাসার গেটের বাইরে ভ্যানে করে সবজি বিক্রেতা, চা দোকানের আড্ডা—যেকোনো জায়গা থেকে ছেলে সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু ছেলেকে তো আর এই ভাইরাস নিয়ে বোঝানোর কোনো উপায় নেই।
শাফাতুন নেসা বললেন, ‘ছেলেকে নিয়ে আমরা অসহ্য হয়ে গেছি। তার বায়না মেটাতে না পারলেই সে কামড় দিয়ে শরীরের গোশত তুলে ফেলে।’
অনলাইন কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিলেন তাঁরা
পিএফডিএ-ভকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট সাজিদা রহমান (ড্যানি)। ২০১৪ সাল থেকে অটিজম ও স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত (১১ বছর বয়স থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের ছেলেমেয়ে) ছেলেমেয়েদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে কাজ করছে বেসরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি। সাজিদা রহমানের আরেকটি পরিচয় তিনি ২৬ বছর বয়সী অটিস্টিক সিয়ামুল করিমের মা। ছেলেকে তিনি একাই বড় করেছেন। ছেলে এ লেভেল সম্পন্ন করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পর্যটনের ডিউটি ফ্রি শপে কাজ করেন। তবে বর্তমানে কাজ বন্ধ করে বাসায় বসে অনলাইনে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেওয়াসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
সাজিদা রহমান জানালেন, পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার করোনাভাইরাসের বিস্তারের শুরু থেকেই অনলাইন কার্যক্রম চালু করেছে। শিক্ষকেরা নিজের বাসায় থেকে ‘অনলাইনের’ মাধ্যমে তাঁর নিজের গ্রুপের ছাত্র ও প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়মিত ক্লাস করাচ্ছেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত কাজের মূল্যায়ন, ‘ইনডিভিজুয়্যাল টার্গেট প্ল্যান (আইটিপি) তৈরি, কেয়ার গিভারদের কাজের দক্ষতার মূল্যায়ন, অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে রেফারাল সম্পর্ক তৈরিসহ সব কার্যক্রমই চলমান। ফলে অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী কেউ অবসর পাচ্ছেন না। সিলেবাসে শিক্ষার্থীদের বাসার কাজ শেখানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আর সাধারণ ছুটিতে বাবারাও বাসায় থাকার সুযোগ পাচ্ছেন, অনেক বাবা সন্তানকে আলুভর্তা মাখানো, ঘর মোছার মতো কাজগুলো শেখাতে গিয়ে বুঝতে পারছেন, এই ধরনের সন্তানের পেছনে একেকজন মাকে কতটা সময় দিতে হয় ও পরিশ্রম করতে হয়। করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে বাইরে যাওয়া যাবে না বা ভাইরাস সম্পর্কে একেকজনকে হয়তো এক হাজারবারও একই কথা বলতে হচ্ছে।
সাজিদা রহমান বললেন, নিম্ন আয়ের অনেক অভিভাবকের পক্ষে সন্তানকে অনলাইনে ক্লাস করানো সম্ভব হচ্ছে না। ওই অভিভাবকদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
অটিস্টিকসহ স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধিতা আছে—এমন শিক্ষার্থীদের জন্য (৩ বছর বয়স থেকে ভর্তি শুরু) তরী ফাউন্ডেশন ও এ ফাউন্ডেশনের অঙ্গসংগঠন স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন ঢাকা এবং রাজশাহীতে স্কুল পরিচালনা করছে। এ দুটি সংগঠনের পরিচালক মারুফা হোসেন। সংগঠন দুটিতে মোট শিক্ষার্থী প্রায় সাড়ে ৪০০। মারুফা হোসেনের মেয়ে আফিয়া কবীর সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হওয়ায় হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন। আফিয়া নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ে অনার্স করছেন।
মারুফা হোসেনের সংগঠন দুটিও করোনাকালে অনলাইন কার্যক্রমের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। মারুফা হোসেন বললেন, করোনাভাইরাসের বিস্তারের বিষয়টি অভিভাবকদের অন্য ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। অভিভাবকদের করণীয় হচ্ছে সন্তানের বুদ্ধির লেভেল অনুযায়ী করোনাভাইরাসের বিষয়টি বুঝিয়ে বলা। এই ধরনের সন্তানদের শারীরিক বিভিন্ন ব্যায়ামের বিষয়টির দিকেও নজর রাখার আহ্বান জানালেন মারুফা হোসেন। আর তিনিও অন্য মায়েদের মতো করোনা বিস্তারের এই সময়ের সুফল হিসেবে সন্তানকে বেশি সময় দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করলেন। তাঁর ভাষায়, অভিভাবকদের ‘ডাবল’ বা কয়েক গুণ বেশি পরিশ্রম করতে হলেও করোনাকালের এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সন্তানকে বেশি সময় দিতে হবে।