রেস্তোরাঁ বন্ধ, আয়ও বন্ধ, দুর্বিষহ অবস্থা রাজুদের
পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডর ৭০ নম্বর হোল্ডিংয়ের দোকানটির কাঠের ভাঁজ করা দরজার একপাশ ভেতর থেকে বন্ধ। সামনে সরু বারান্দা। আধখোলা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখা গেল ভরদুপুরেও আবছা অন্ধকার। এটি ঢাকার এক ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান ‘হাজির বিরিয়ানি’র হোটেল। চলছে সেই ১৯৩৯ সাল থেকে। এখন বন্ধ।
হোটেলের ভেতর চেয়ারগুলো টেবিলের ওপরে রাখা। এক পাশে অন্দরমহলে প্রবেশের দরজা। সেটি দিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখা গেল পাকা উঠানে বিরিয়ানি রান্নার ডজনখানেক বিশাল ডেকচি সারি দিয়ে রাখা। উঠানের চারপাশে পুরান ঢাকার প্রাচীন স্থাপত্যরীতির গায়ে গায়ে লাগানো ঘর। হাঁকডাক দিতে তার একটি থেকে মাঝবয়সী একজন বেরিয়ে পরিচয় দিলেন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক, হাজি মোহাম্মদ আশু বলে। তিনি প্রতিষ্ঠাতা হাজি মোহাম্মদ হোসেনের মেয়ের ঘরের নাতি। জানালেন, করোনার জন্য গত মাসের ২৪ তারিখ থেকে চুলা জ্বলেছে না। বাবুর্চি, পরিবেশক মিলিয়ে প্রায় ২২ জন কর্মচারী ছিলেন। সবাইকে ছুটি দিয়েছেন। তাঁরা সবারই ‘কাজ করলে মজুরি’—এই চুক্তিতে কাজ করতেন। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় যে যাঁর মতো চলে গেছেন, কোনো মজুরি ছাড়াই।
সোলেমান মল্লিক মিরপুরের ১১ নম্বর সেকশনের হাজির বিরিয়ানির বাবুর্চি। তিনি প্রায় খালি হাতেই বউ আর দুই বাচ্চা নিয়ে শরীয়তপুরে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন ২৪ তারিখেই। টেলিফোনে বললেন, দিন ৭০০ টাকা মজুরির সঙ্গে তিন বেলা খাবার পেতেন। কাজ বন্ধ। ঢাকায় থেকে কী করবেন। বাধ্য হয়েই গ্রামে এসেছেন। এখানে আত্মীয়স্বজন আছে, তাদের কাছে ধার কর্জ করে চলছেন। ঢাকায় থাকলে অবস্থা আরও খারাপ হতো, সেখানে ধারকর্জ দেওয়ার লোকও নেই। বাড্ডার হজরত শাহ চন্দ্রপুরি হোটেলের বাবুর্চি রাজু আহমেদ তাঁর গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীতে যেতে পারেননি। উত্তরার ১০ নম্বর সেকশনের কামারপড়ার ভাড়া বাসাতেই আছেন। খুবই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে আছেন। তাঁরও বেতন রোজ ৭০০ টাকা। কামারপাড়ায় টিনের ছাউনির সেমিপাকা দুই ঘরের বাড়ির ভাড়া সাড়ে আট হাজার টাকা। দুটো ছেলে স্কুলে পড়ে। জমানো টাকা বিশেষে হাতে থাকে না। সামান্য সেই সঞ্চয় প্রথম সপ্তাহেই শেষ। এদিকে বাড়িভাড়া দিতে হবে। চলছেন ধারকর্জ করে। এ ভাবে আর কত দিন চলবে! গ্রামের বাড়িতেও যেতে পারছেন না। বললেন, ছেলেদের মুখে কী দেবেন, নিজেরাই বা কী খাবেন! আগামী দিনগুলো কেমন করে যাবে—এসব ভেবে রাতে দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না। টেলিফোনেই কথা হলো পুরান ঢাকার স্টার হোটেলের খাদ্য পরিবেশক মিজানুর রহমান, ধোলাইখাল এলাকার মহিউদ্দিন হোটেলের বাবুর্চি জয়নাল আবেদিনসহ অন্তত জনাদশেক হোটেলশ্রমিকের সঙ্গে। তাঁরা কেউ ঢাকায়, কেউ গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। ঘুরেফিরে সবারই এক কথা। কাজ তো নেই-ই, হাতে টাকা নেই, ধারকর্জও তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁরা এত দিন সুস্বাদু খাবার রান্না করেছেন, পরিবেশন করেছেন, আজ তাঁদের ঘরে খাবার নেই। অনেকে ঘরে চুলো জ্বলছে না। পাননি কোনো ত্রাণসাহায্য। ঘরে বন্দী অবস্থায় বড় অমানবিক জীবন যাপন করছেন তাঁরা।
গত রোববার দুপুরে কাজী আলাউদ্দিন রোড থেকে পুরান ঢাকার আরেক প্রসিদ্ধ খাবার দোকান আরমানিটোলার নান্নার বিরিয়ানির দিকে যেতে যেতে চোখে পড়ল খাবারের দোকানগুলোর সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা রাখার সুযোগ থাকলেও অন্য সব দোকানের মতো এগুলোরও ঝাঁপ বন্ধ। পুরান ঢাকা চেনাই যায় না। হাতের তালুর রেখার মতো ছড়িয়ে থাকা যে অজস্র সরু অলিগলি হরেক রকম যানবাহন আর লোকের ঠাস বুনোটে ভরে থাকে সারা দিন, সেগুলো শূন্য পড়ে আছে। তারা মসজিদ পেরিয়ে বেচারাম দেউড়ীর মোড়েই হাজি নান্নার বিরিয়ানির দোকান। ঝাঁপ বন্ধ। সাইনবোর্ড লেখা দুটি সেল ফোন নম্বরে ক্রমাগত ফোন করেও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
আরেক খ্যাতনামা দোকান ধোলাইখালের ঝুনুর মোরগ পোলাওয়ের দোকান অবদি যাওয়াই গেল না। সড়কের মুখে আড়াআড়িভাবে বাঁশ ফেলে প্রতিবন্ধক দেওয়া। দোকানপাট সব বন্ধ। ফিরতি পথে বেইলি রোডে ফখরুদ্দীন বাবুর্চির প্রধান কেন্দ্রে দেখা গেল মূল ফটক বন্ধ। পকেট গেটটি খোলা। ভেতরে গিয়ে পাওয়া গেল হাজি রফিকে। তিনি ফখরুদ্দীনপুত্র, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার দায়িত্বে। বললেন, ঢাকায় তাঁদের আটটি শাখা, সব বন্ধ। খাবারেরে দোকান খোলা রাখার সুযোগ থাকলেও দোকান খুলে লাভ নেই কারণ, খদ্দের নেই। লোকজন তো ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। তাই তাঁরা ২৫ তারিখ থেকেই সব দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁদের সব মিলিয়ে নিয়মিত কর্মচারী প্রায় ৮০ জন। যাঁর যা পাওনা ছিল সব মিটিয়ে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। বললেন, হোটেলের শ্রমিক–কর্মচারীরা স্বল্প আয়ের মানুষ, ওরা খুব কষ্টে আছে কিন্তু তাঁদের বিশেষ কিছু করার নেই।
হোটেলশ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে কথা হলো বাংলাদেশ হোটেল-রেস্টুরেন্ট-সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আবদুল খালেক ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, ঢাকায় হোটেলশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। প্রায় সবাই ‘কাজ করলে মজুরি’ এই চুক্তিতে নিয়োজিত। সাধারণত প্রতিদিনের মজুরি দিনের বেচাকেনা শেষে রাতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সর্বনিম্ন ৩ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ বেতন ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এদের মধ্যে বাবুর্চিরা উচ্চ বেতন পান। এদের সংখ্যা মোট শ্রমিকের শতকরা ৫ ভাগ। এরপরের স্তরের বেতন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা, প্রায় ৬০ শতাংশ শ্রমিক এই বেতন পান। বাকি ২৫ শতাংশের বেতন সাড়ে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা। বাকি ১০ শতাংশ শ্রমিকের বেতন ৩ হাজার টাকা। তাঁরা পানি দেওয়া, টেবিল পরিষ্কার করা—এসব কাজ করেন।
বাংলাদেশে হোটেল শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি মাসিক ৩ হাজার টাকা, এটা সার্কভুক্ত সব দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে দীর্ঘদিন থেকে শ্রমিকের আন্দোলন করছেন বলে নেতারা বললেন। জানালেন, তাঁরা চান একটি জাতীয় মজুরি বোর্ড গঠন করা হোক, কিন্তু তা হচ্ছে না। প্রত্যেক শিল্পশ্রমিকদের জন্য পৃথক মজুরি বোর্ড রয়েছে, হোটেলশ্রমিকদের মজুরি বোর্ড করা হয়েছে ২০১৭ সালে। এখানে তাঁদের কোনো প্রতিনিধি নেই। শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে যিনি আছেন, তিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা। হোটেলশ্রমিকদের সঙ্গে তাঁর কোনো যুক্ততা নেই। আগে পাঁচ সদস্য নিয়ে পরিবার গণ্য করা হতো, ২০১৮ সাল থেকে স্বামী-স্ত্রী দুই সন্তান এবং বাবা-মাকে যুক্ত করে ৬ সদস্যের পরিবার গণ্য করা হয়েছে। বর্তমান বাজারদর অনুসার ৬ সদস্যের পরিবারের ন্যূনতম খরচ হিসেব করে তাঁরা হোটেলশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি এগোয়নি। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি নিয়েই তাঁরা আন্দোলন করছেন। এর মধ্যে নিম্ন আয়ের এই প্রান্তিক শ্রমিকদের জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই আয়ের পথ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হলো। এখন পরিবার পরিজন নিয়ে এসব শ্রমিকদের না খেয়ে মরতে হবে। সারা দেশে হোটেলশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ বলে তাঁরা জানালেন।
মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব রেজাউল করিম সরকার ও সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন মৃধা জানালেন, হোটেলশ্রমিকদের সঠিক সংখ্যা বলা কঠিন। তাঁদের হিসাবে সারা দেশে ছোট–বড় হোটেল-রেস্তোরাঁ অর্থাৎ খাবারের দোকানের সংখ্যা ৫৫ থেকে ৬০ হাজার। এর মধ্যে ঢাকায় আছে ১০ হাজারের কাছাকাছি। প্রতি দোকানে ২০ জন করে শ্রমিকের ধরে তাঁদের হিসাবে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ১২ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ। এ ছাড়া খাবারের দোকানের সঙ্গে মাছ, সবজি, মাংসসহ বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহকারী হিসাবে আরও প্রায় ৬ লাখ মানুষ জড়িত। প্রত্যেকর একটি পরিবার। সব মিলিয়ে প্রায় এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত লোকসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এদের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মালিক–নেতারা জানালেন, গত ১৫ মার্চ থেকেই হোটেল রেস্তোরাঁয় বিক্রি কমে আসছিল। দেশের মোট খাবারের দোকানের মধ্যে ভালো অবস্থায় আছে মাত্র ১০ হাজারের মতো। দোকান বন্ধ থাকলেও তাদের শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার সামর্থ্য আছে। বাকি প্রায় ৪০-৫০ হাজার একরকম প্রতিদিনের আয় থেকে চলে। এ ব্যবসার ধরনটাই এমন। কাজেই প্রতিষ্ঠান বেশি দিন বন্ধ থাকলে কেবল শ্রমিক নয়, মালিকদেরও বাড়িতে চুলা বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁরা ২০ মার্চ মালিক সমিতির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একটা লিখিত আবেদন করেছিলেন। এতে ভ্যাট মওকুফ, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল পরিশোধ না করলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করা, ব্যাংকঋণগ্রস্তদের খেলাপি না করা, শ্রমিকদের জন্য জরুরি খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার আবেদন ছিল। সেবা সংস্থার বিল না দিলেও সংযোগ অব্যাহত রাখার ঘোষণা এসেছে। তবে চলতি মাসের ১৪ তারিখের মধ্যেই মার্চ মাসের ভ্যাট পরিশোধের চিঠি দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ মালিকের হাতে টাকা নেই।
হোটেল বন্ধ , ভ্যাট দিতে গেলে হাত আরও শূন্য হয়ে পড়বে। তবু মানবিক দিকটি বিবেচনা করে শ্রমিকদের অন্তত অর্ধেক বেতন হলেও দিতে চেষ্টা করবেন। এ জন্য শিগগিরই সমিতির নেতাদের নিয়ে সভা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। হোটেলশ্রমিকদের সম্পর্কে দেশর ৪৩টি শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় ফেডারেশন শ্রমিক জোট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এ বি এম জাকিরুল হক বলেনে, হোটেলশ্রমিকেরা খুবই অল্প আয়ে কাজ করেন। এই দুর্যোগের সময় মালিকদের উচিত শ্রমিকদের অন্তত এক মাসের বেতন দেওয়া। এর পাশাপাশি সরকারে পক্ষ থেকে বিভিন্ন পেশার শ্রমিকদের জন্য পৃথকভাবে জরুরি খাদ্য এবং আর্থিক সহায়তা দেওয়ার দাবি জানান।