নাজিম যেখানেই যান, পেটান
সাদা শার্ট ও লুঙ্গি পরা এক বৃদ্ধের কলার চেপে ধরে খেতের আল ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। কুড়িগ্রামে বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে নির্যাতনের রোমহর্ষ বর্ণনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পর এমন একটি ভিডিও আবারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। নেটিজেনরা জানতে পারেন, ছবির ওই নির্যাতক কুড়িগ্রামের বর্তমান রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দীন। তবে ভিডিওর ঘটনাটি কক্সবাজারের।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেটিজেনরা মন্তব্য করছেন, শুধু বদলি না করে নাজিম উদ্দীনের ওই সময় শাস্তি হলে কুড়িগ্রামে তিনি সাংবাদিক পেটানোর সাহস পেতেন না।
আজ রোববার জামিনে মুক্তির পর আরিফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘রাতে ঘরে ঢুকেই আরডিসি নাজিম উদ্দিন আমার মাথায় কিল-ঘুষি মারতে শুরু করেন। মারতে মারতে আমাকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে চোখ-হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। এরপর আমাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে এনকাউন্টারে দেওয়ার হুমকি দেয়। আমাকে নাজিম বারবার বলেন, আজ তোর জীবন শেষ। তুই কলেমা পড়ে ফেল, তোকে এনকাউন্টারে দেওয়া হবে।’
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, নাজিম উদ্দীন শুধু কক্সবাজারে নয়, এখন পর্যন্ত যেখানেই চাকরি করেছেন, সেখানেই কোনো না কোনো ঘটনা ঘটিয়েছেন। প্রশাসনে তিনি বদমেজাজি কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত।
নাজিমের সঙ্গে চাকরি করেছেন এমন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষানবিশ সময়ে তিনি বাগেরহাটের মোংলায় একটি ছোট ফার্মেসিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। ফার্মেসির মালিককে তিনি এক লাখ টাকা জরিমানার পাশাপাশি চড়-থাপ্পড় মারেন বলেও অভিযোগ ওঠে। ওই সময় জেলা প্রশাসক তাঁর ম্যাজিস্ট্রেসি বা বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন। পরে সহকর্মীদের অনুরোধে তাঁর আর শাস্তি হয়নি।
এরপর নাজিম উদ্দীনের কর্মস্থল ছিল কক্সবাজার। সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়ে ২০১৮ সালে তিনি কক্সবাজারের কলাতলীর মোহাম্মদ আলী ওরফে নফু মাঝিকে ধরে নিয়ে আসেন। সেই ভিডিও পরে ভাইরাল হয়।
মোহাম্মদ আলীকে উদ্ধৃত করে সে সময় সংবাদমাধ্যমে খবর বেরোয়, কোনো কিছু না বলেই হঠাৎ সহকারী কমিশনার লোকজন নিয়ে জমি মাপজোখ শুরু করেন। তারপর তাঁকে পেটান ও টেনেহিঁচড়ে একটি টমটমে তোলেন। পরে এসি ল্যান্ড অফিসে নিয়ে তাঁকে সাক্ষ্য দিতে জোরাজুরি করেন, নাজিম উদ্দীন তাঁকে কিছুই করেননি। তবে নাজিম সে সময় দাবি করেছিলেন, ওই বৃদ্ধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাইছিলেন না বলে তাঁকে টেনে নেওয়া হয়।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর অধীনে কিছুদিন চাকরি করেছেন নাজিম উদ্দীন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় দুই মাস পর তাঁকে রাঙামাটির লংগদুতে বদলি করা হয়।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে কক্সবাজারের সে সময়কার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ওই ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় তাঁকে বদলি করা হয়েছিল। লংগদু থেকে তিনি আবার বাগেরহাটে ফেরার চেষ্টা করেন। তবে তাঁর বদলি হয় মাগুরার মহম্মদপুরে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে মহম্মদপুরের নহাটা বাজারের ঘরমালিক ও ব্যবসায়ীরা নাজিম উদ্দীনের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন। তাঁদের অভিযোগ, বিনা নোটিশে নাজিম উদ্দীন তাঁদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়েছেন। দোকানদারদের কিল-ঘুষি দিয়েছেন এবং গালিগালাজ করেছেন। নাজিম দাবি করেছিলেন, ওগুলো খাসজমিতে অবৈধ স্থাপনা।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে নাজিম উদ্দীনের মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও তিনি ধরেননি।
নাজিমউদ্দীন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনে যোগ দেন গত বছরের ২৭ নভেম্বর। তিনি ৩৩তম বিসিএসের কর্মকর্তা। লেখাপড়া করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর গ্রামের বাড়ি যশোরে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন প্রথম আলোর বাগেরহাট ও মাগুরা প্রতিনিধি)