ধ্বংসের কিনারে পুরাকীর্তি
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসের কিনারে পুরোনো পিরোজপুরের রায়েরকাঠী রাজবাড়ি। রাজবাড়ির ভবনগুলোর ছাদ ভাঙা। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। কয়েকটি ভবন সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। রাজবাড়ির নবরত্ন মঠসহ তিনটি মঠের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। সাড়ে ৩০০ বছরের এই নিদর্শন বিলীন হওয়ার পথে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজবাড়ির ৭৫ ফুট উচ্চতার ১১টি মঠের একটি সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। আরও দুটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাকি মঠগুলোও সংস্কার করা না হলে অচিরেই ধসে পড়বে।
এ সম্পর্কে রায়েরকাঠী রাজবংশের বংশধর গৌতম নারায়ণ রায় চৌধুরী বলেন, রাজবাড়ি ও মঠগুলো সংরক্ষণ করা খুবই ব্যয়বহুল। অর্থাভাবে ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় রাজবাড়ির পাকা ভবনগুলো সংস্কার করা যায়নি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে এগুলো সংরক্ষণের জন্য আবেদন করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি মঠ সংস্কার করা হয়েছে। আরও দুটি মঠ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।
তবে গৌতম নারায়ণ রায় চৌধুরী জানান, নির্মাণশ্রমিকেরা সংস্কার করতে গিয়ে নির্মাণশৈলী নষ্ট করে ফেলছেন। তাঁরা মঠের দেয়ালের পুরোনো অলংকরণ নতুন করে করতে পারছেন না। এতে মঠটির মুঘল আমলের নির্মাণশৈলী হারিয়ে গেছে।
পিরোজপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে রায়েরকাঠী গ্রাম। এখানেই রাজবাড়ির অবস্থান। রাজবাড়িতে রয়েছে রাজভবন, নহবতখানা, অতিথিশালা, নাট্যশালা ও অসংখ্য মন্দির। এ ছাড়া রয়েছে ছোট-বড় প্রায় অর্ধশত অট্টালিকা। ২০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজবাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রয়েছে কালী ও শিবমন্দির। কালের বিবর্তনে ধ্বংসের পথে রাজবাড়ির অধিকাংশ ভবন। বর্তমানে পাঁচটি ভবন চোখে পড়ে।
পিরোজপুরের ইতিহাস গবেষক গোলাম মোস্তফা তাঁর ‘সংগ্রামী পিরোজপুর’ বইয়ে লিখেছেন, সম্রাট আকবরের সময় যুবরাজ সেলিম (সম্রাট জাহাঙ্গীর) বিদ্রোহ করে বাংলা মুলুকে আসেন। এরপর তিনি ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ নিয়ে একটি পরগনার সৃষ্টি করেন। নিজের নামে পরগনার নাম রাখেন সেলিমাবাদ। ১৬১৮ সালে সেলিমাবাদ পরগনার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পান মদন মোহন। ১৬২৮ সালে মদন মোহন তাঁর ছেলে শ্রীনাথের নামে সেলিমাবাদ পরগনার পাট্টা নেন। শ্রীনাথ ঝালকাঠির লুৎফাবাদ গ্রামে কাচারি স্থাপন করে সেখানে বসবাস করতেন। এরপর মুঘল সম্রাট শ্রীনাথকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৬৫৮ সালের শ্রীনাথ রায়ের ছেলে রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিরোজপুরের অদূরে বসবাস শুরু করেন। সেখানে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে রাজবাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বনজঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে রাজ্য স্থাপন করে সেই স্থানের নামকরণ করেন রায়েরকাঠী।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, রাজবাড়ির প্রধান ফটক, রাজাদের বসবাসের বহুতল ভবনগুলো, বিচারালয়, কাচারিঘর, জলসাঘর, অন্ধকূপ—সবই ভেঙে গেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মূল রাজবাড়িটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও কালের সাক্ষী হয়ে আছে ৩৬২ বছরের প্রাচীন কালীমন্দির ও ৭৫ ফুট উচ্চতার ১১টি মঠ। ইট-সুরকি দিয়ে নিখুঁত গাঁথা মঠগুলোর নির্মাণশৈলী মুঘল স্থাপত্যকলার সাক্ষী। মঠগুলোর দেয়ালে মাটির অলংকরণ গেছে ক্ষয়ে। জন্মেছে শেওলা ও লতাপাতা। একটি মঠে (মন্দির) সংরক্ষিত আছে কষ্টিপাথরের মহামূল্যবান শিবমূর্তি। সাড়ে পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যের ও প্রায় ২৫ মণ ওজনের শিবলিঙ্গটি এশিয়া মহাদেশের বৃহৎ শিবমূর্তিগুলোর একটি। মন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা জানান, একসময়ে প্রতিটি মঠে এ রকম শিবমূর্তি সংরক্ষিত ছিল। পরে তা চুরি হয়ে যায়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান বলেন, ‘রায়েরকাঠী রাজবাড়িটি সম্পর্কে আমাদের কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই। তবে এ ব্যাপারে লিখিত আবেদন পেলে আমরা সরেজমিনে দেখে রাজবাড়ি ও মন্দির সংরক্ষণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠাতে পারি। এ ব্যাপারে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।’