নিরাপদে আ.লীগ, সংকটে বিরোধীরা
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তাঁর মিত্রদের একচেটিয়া জয় দিয়ে শেষ হয়েছিল ২০১৮ সাল। আর ২০১৯ শুরু হয় বড় মন্ত্রিসভা দিয়ে, যেখানে ছিল নতুন মুখের ছড়াছড়ি। এরপর থেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটাই চুপসে যায়। এই সময়ে বাধাবিপত্তিহীন সরকারি দল দিবসভিত্তিক কর্মসূচি পালনেই সীমাবদ্ধ ছিল। বছরের তৃতীয় ভাগে ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযান এবং শেষ ভাগে জাতীয় সম্মেলন সরকারি দলের ভেতর-বাইরে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল।
তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৯ সালে বছরজুড়েই ভোট ও গণতন্ত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এর বিপরীতে সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে এসব প্রশ্ন চাপা দিতে চেয়েছে। একদিকে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, নতুন করে নেওয়া হচ্ছে আরও মেগা প্রকল্প। উন্নয়নের এই স্রোতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, পরিবেশ ও সুশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অনেকটাই চাপা পড়ে ছিল। গত এক বছরের রাজনীতি পর্যালোচনা করে বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আরও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে।
২০১৯ সালে সরকার ও সরকারি দল মিলেমিশে একাকার ছিল। যদিও বছরের শেষ ভাগে এসে জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে দলের নেতৃত্ব ও মন্ত্রিত্বের মধ্যে সীমারেখা টানার চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, দল হচ্ছে দলের, কিন্তু সরকার হচ্ছে সবার। দল ও সরকার যদি একই সত্তায় মিশে যায়, তাহলে সংসদীয় ব্যবস্থা কার্যকর ও অর্থবহ থাকে না।
২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাঁর প্রতিবেদন পেশ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সরকারের মধ্যে দলকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না, দল শক্তিশালী না হলে সরকার শক্তিশালী হবে না।’ তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য ভিন্নমত খুব একটা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, দল ও সরকার আলাদা থাকা উচিত। একই ব্যক্তি দল ও সরকারে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেন না। ভারত অনেক আগে থেকেই এটি অনুশীলন করছে। এবারের জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এই চর্চাটা শুরু করেছে, এতে সুফল আসতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
রাজনীতিতে ক্যাসিনো-ঝড়
ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সব দিক দিয়েই নিরাপদ ছিল। বড় কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজির অভিযোগ ওঠার পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী সংগঠন থেকে বাদ পড়েন। এর পরপর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর জুয়া ও ক্যাসিনো-কাণ্ডের সঙ্গে যুবলীগ নেতাদের সরাসরি যুক্ত থাকার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। এর জের ধরে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার হন যুবলীগের ঢাকা মহানগর সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী ওরফে সম্রাট ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ হোসেন ভূঁইয়া। কারাবন্দী হন কথিত যুবলীগ নেতা ও প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীম। সব মিলিয়ে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শুদ্ধি অভিযানের মুখে বাদ পড়েন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথ। সমালোচনার মুখে পড়েন কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগসহ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতারা। ফলে বছরের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলন হয় এবং পুরোনোদের অনেকেই বাদ পড়েন। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসে।
বিএনপির ‘মুক্তি চাই’ রাজনীতি
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে। নির্বাচনের মাঠে দাঁড়াতে পারেননি দলটির নেতা-কর্মীরা। বিএনপির শীর্ষ নেতারাও ছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলও পরে তা আলগা হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের বিএনপি পায় বা তাদের দেওয়া হয় মাত্র ছয়টি আসন। দলটির অভিযোগ, ভোটের আগের রাতেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের প্রার্থীর সমর্থকেরা ব্যালট পেপারে সিল মেরেছেন। অনেক কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। আবার নৌকা প্রতীকে শতভাগ ভোট পড়ার উদাহরণও আছে। বিএনপি এই নির্বাচনকে ‘মিডনাইট ইলেকশন’ আখ্যা দিয়ে ফল প্রত্যাখ্যান করে এবং দলীয় সাংসদেরা শপথ নেবেন না বলে ঘোষণা দেয়। শেষ পর্যন্ত ওই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি বিএনপি। নাটকীয় নানা ঘটনার পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া বিএনপির পাঁচ সাংসদ শপথ নেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন ওঠে যে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ব্যক্তিরা সংসদে গেলে খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পাবেন। তাঁরা সংসদে গিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি তোলেন। কিন্তু তাঁর মুক্তি হয়নি। ১২ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। অন্যদিকে আন্দোলন করে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো অবস্থায়ও নেই বিএনপি। এ অবস্থায় আইনি প্রক্রিয়ায় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করাকেই মূল লক্ষ্য করেন দলটির নেতারা।
খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কারণে কারাগারে, এমনটা বলে থাকে বিএনপি। কিন্তু রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারেনি দলটি। আইন-আদালতের পাশাপাশি বিক্ষোভ, সমাবেশ ও সেমিনারের আয়োজন করেছে। তবে তা ছিল অনেকটাই ঢিলেঢালা।
এর কারণ সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, দলের প্রধান নেত্রীর মুক্তির জন্য যে আন্দোলন-সংগ্রাম দরকার ছিল, তা করতে পারেনি দলটি। তিনি মনে করেন, এক দিকে সরকারের দমন-পীড়নের ভয়, আরেক দিকে সাংগঠনিক বা নেতৃত্বের দুর্বলতা ছিল। এ ছাড়া আন্দোলন-সংগ্রামের পরীক্ষায় দলটির নেতা-কর্মীরা উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
গায়েবি মামলা নিয়েও বিএনপি শক্ত কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি। দলটি অভিযোগ করেছে, ঘটনাই ঘটেনি, তারপরও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সারা দেশে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চার হাজারের অধিক সাজানো মামলা দিয়ে লাখ লাখ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়।
সংসদের বিরোধী দলও সরকারের নিয়ন্ত্রণে
দশম সংসদের মতো একাদশ সংসদেও বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। আর দলটি আগের মতোই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। জাতীয় পার্টির প্রধান এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই জি এম কাদের এবং স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে বিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে। পরে সমঝোতার মধ্য দিয়ে রওশন সংসদে বিরোধী দলের নেতা হন। আর জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান। ২৮ ডিসেম্বর দলটির সম্মেলন হয়। জি এম কাদের চেয়ারম্যান ও রওশন এরশাদকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়েছে।
কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় গত এক বছরে সংসদে বড় রাজনৈতিক বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি যুক্তি ছিল না। সংসদ প্রাণবন্ত না হওয়ায় সংসদীয় কমিটিগুলো শুধু রুটিন বৈঠক করছে।
তবে রাজনীতির অঙ্গনে পরস্পরবিরোধী উত্তপ্ত সমালোচনার ঘটনা ঘটেছে। সরকারি দলের নেতা এবং কয়েকজন মন্ত্রীর সমালোচনা ছিল মূলত খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও জিয়াউর রহমানকে ঘিরে। খালেদা জিয়া মুক্তি না পাওয়ায় বিরোধীরা সরকার ছাড়াও আদালতের সমালোচনা করেছে। রাজনীতির মাঠে সরকারি দলের নেতারা বিএনপির আন্দোলনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আর বক্তৃতা-বিবৃতিতে সরকারের দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার ও হামলা-মামলার ঘটনা বছরজুড়ে তুলে ধরেছে বিএনপি।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছাকাছি সম্পর্ক থাকতে হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ না হোক, কিছুটা সহযোগিতামূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে মানানসই নয়।
দল ও জোটে ভাঙন
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের পর ছোট ছোট অনেক দল ভেঙেছে। জামায়াতে ইসলামী ভাঙনের মুখে পড়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের আলোচিত প্ল্যাটফর্ম জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ভেঙেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিও (এলডিপি) বিভক্ত হয়। ১৪-দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিতে দুটি ধারা তৈরি হয়েছে। এর আগে জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হওয়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) আলাদা পথেই হেঁটেছে।
বিএনপি থেকেও পদত্যাগ করেছেন বা সরে গেছেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান।
গত এক বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে অধ্যাপক আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, বিপুল জনসমর্থন থাকলেও বিএনপি একটি বড় জমায়েত করতে পারে না। জামায়াতের যে কথিত আদর্শভিত্তিক রাজনীতির কথা বলা হতো, তা এখন গতানুগতিক রাজনীতির ধারায় চলে গেছে। বিভেদে পড়ে জাতীয় পার্টি স্তিমিত হয়ে গেছে। বামপন্থী সংগঠনগুলোর বেশির ভাগই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকনির্ভর ও প্যাডসর্বস্ব হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, যেখানে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন চলছে, সেখানে তাদের কাছ থেকে সুষ্ঠু রাজনীতি এবং গণতন্ত্রকে কাঠামোগত রূপ দেওয়ার মতো ভূমিকা আশা করা যায় না।
অস্তিত্বসংকটে বিরোধী দল
গত বছরের রাজনৈতিক আলোচনায় ঘুরেফিরে এসেছে বিরোধী দল বলে কিছু থাকবে কি না। নব্বই-পরবর্তী সময়ে দুবার ক্ষমতায় থাকা বিএনপির পরিণতি মুসলিম লীগের মতো হবে কি না, এমন আলোচনাও ছিল। তবে গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য কার্যকর বিরোধী দল থাকা উচিত বলে মত দিয়েছেন রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকেরা।
বিদায়ী বছরের রাজনীতি ও আগামীর প্রত্যাশা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতিতে যেসব আলোচনা, সম্মেলন, কর্মসূচি, বক্তৃতা-বিবৃতি দেখলাম, এগুলো নতুন কিছু নয়। এর মধ্যে উত্তরণ বা পতন নেই। তবে যেটি দেখা যায়, তা হলো দেশে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা বাড়ছে। তিনি বলেন, “যেভাবেই হোক, দেশে একটি বড় রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। গণতন্ত্র ও সুশাসনের স্বার্থে এই শূন্যতা পূরণ করতে চাই সংবিধানের চার মূল নীতির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী বিরোধী দল।”