দেশে নবজাতকের মৃত্যুহার কমছে না
দেশে নবজাতকের মৃত্যুহার কমছে না। ১ হাজার নবজাতক জন্ম নিলে ৩০টি মারা যাচ্ছে বয়স ২৮ দিন হওয়ার আগেই। পাঁচ বছর আগে এই হার ছিল ২৮। এক বা পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের পরিস্থিতিও ভালো নয়।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ (বিডিএইচএস) প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অতীতে ধারাবাহিকভাবে এক বছর বয়সী শিশুর মৃত্যুহার কমে এলেও গত পাঁচ বছরে তা থেমে আছে। ২০১৪ সালে এক বছর বয়সী শিশুর মৃত্যুহার ছিল ৩৮। এখনো তাই। গত শনিবার প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
দেশে শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতিতে কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃ নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেদনে কী আছে, তা তিনি জানেন না। নবজাতকের মৃত্যু বা এক বছর বয়সী শিশুর মৃত্যু কেন কমছে না, সে বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। অন্যদিকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মোহাম্মদ শরীফ বলেন, সমন্বিত নবজাতক জরুরি সেবা কর্মসূচি চালু হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, ডায়রিয়াজনিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, পুষ্টি কর্মসূচি শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে। কৃমিনাশক, ভিটামিন ‘এ’ কর্মসূচি শিশুদের অবস্থার উন্নতি করেছে। অন্যদিকে নিরাপদ প্রসব কর্মসূচি, প্রসব-পূর্ববর্তী সেবা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব—এসবও শিশুর মৃত্যুহার কমিয়েছে। শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতিতে একসময় দাতাগোষ্ঠী ও এনজিওগুলোর অনেক কাজ ছিল। কিন্তু এখন ক্রমেই এগুলো সংকুচিত হচ্ছে। অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিকে জরুরি অবস্থায় অনেকে সেবা পায় না। আবার মানসম্পন্ন সেবার ব্যাপারেও অনেক অভিযোগ আছে।
বিডিএইচএস প্রতিবেদন (২০১৭-১৮) তৈরি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় জনসংখ্যা জরিপ ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)। যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা এই জরিপে বরাবরের মতো আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। কারিগরি সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেরই আইসিএফ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
>অতীতে ধারাবাহিকভাবে এক বছর বয়সী শিশুর মৃত্যুহার কমে এলেও গত পাঁচ বছরে তা থেমে আছে।
৬৪টি জেলার ৬৭৪টি নমুনা এলাকার ২০ হাজার ২৫০টি খানার তথ্য এই জরিপ প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ২০ হাজার ১০০ নারীর সাক্ষাৎকারের তথ্য এতে আছে। মিত্র অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস নামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তথ্য সংগ্রহের পুরো কাজটি করে অক্টোবর ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের মার্চের মধ্যে। এর আগের জরিপ হয়েছিল ২০১৪ সালে।
১৯৯৩ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত আটটি জরিপ হয়েছে। বাংলাদেশের শিশুস্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা এসব বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় এই প্রতিবেদনে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক, দেশি-বিদেশি গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিজ্ঞানী, পরিকল্পনাবিদেরা এই জরিপের তথ্য ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
শিশুমৃত্যুর প্রবণতা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশুমৃত্যুর হার একটি দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ও জীবনমানের সূচক হিসেবে কাজ করে। বিডিএইচএস ২০১৭-১৮ জরিপের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের মৃত্যুর মাত্রা ও প্রবণতা পরিমাপ করা। প্রতিবেদনে নবজাতক, এক বছর বয়সী শিশু ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের তথ্য পৃথকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
২৮ দিন পর্যন্ত বয়সীরা নবজাতক। ২০০৭ সালে নবজাতকের মৃত্যুহার ছিল ৩৭। এর পরের প্রতিটি জরিপে এই হার কমতে দেখা যায়। সর্বশেষ ২০১৪ সালে ছিল ২৮। আর এখন তা ৩০। এক বছর বয়সীদের মৃত্যুর হারও অতীতে কমেছে।
নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, গৎবাঁধা সেবা দিলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না। সেবার পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি সেবার মান বাড়ানোতে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, গর্ভবতীর প্রসবপূর্ব সেবা বাড়ালে এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বাড়লে নবজাতকের মৃত্যু কমবে।
পরিবার পরিকল্পনা পরিস্থিতি খারাপ
বাংলাদেশ জনসংখ্যা খাতে সাফল্য অর্জন করেছিল মূলত মোট প্রজনন হার (টিএফআর-টোটাল ফার্টিলিটি রেট) কমানোর মধ্য দিয়ে। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রজননক্ষম একজন নারী মোট কয়টি সন্তানের জন্ম দেয়, সেটিই টিএফআর। ১৯৭১ সালে একজন নারী গড়ে ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন, তখন টিএফআর ছিল ৬ দশমিক ৩। ২০১১ থেকে পরিস্থিতি আর কমছে না।
নতুন জরিপ বলছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হারও অনেকটা থমকে আছে। ১৯৭৫ সালে সক্ষম দম্পতির ৮ শতাংশ কোনো না কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করত। এরপর বছর বছর তা বাড়তে থাকে। ২০১১ সালে এই হার ৬১ শতাংশে পৌঁছায়। ২০১৪ সালে সামান্য বেড়ে ৬২ শতাংশ হয়। আর এখন তা ৬২ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের বাড়ি বাড়ি ঘোরা এবং গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়েছিল। এখন জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবার ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, মাঠপর্যায়ে অনেক পদ খালি। আবার মাঠকর্মীদের অনেকের বয়স বেশি হওয়ায় বাড়ি বাড়ি যান না। প্রচারের ক্ষেত্রেও উদ্যোগে ভাটা পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কিশোরী মায়েদের মধ্যে টিএফআর বেশি। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে না পারলে টিএফআর কমানো কঠিন হবে। এর পাশাপাশি সিলেট, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে কর্মসূচিতে আরও জোর দিতে হবে।
শিশুপুষ্টির উন্নতি
বিডিএইচএস ২০১৭-১৮ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, শিশুপুষ্টির সূচকে দেশ উন্নতি করেছে। শিশু যদি ধারাবাহিকভাবে অপুষ্টিতে ভোগে, তাহলে তার উচ্চতা বয়সের তুলনায় কমে যায়, শিশু খর্বাকৃতির হয়। খর্বকায় শিশুর হার দেশে ক্রমাগত কমছে।
বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশুর হারও কমেছে। ২০০৭ সালে ছিল ৪১ শতাংশ। আর এখন তা ২২ শতাংশ। অন্যদিকে হঠাৎ তীব্র অপুষ্টির শিকার হওয়া শিশুর হারও আগের চেয়ে কমেছে। এসব শিশুর উচ্চতার তুলনায় ওজন কম থাকে। এই প্রথম এই হার এক অঙ্কে নেমে এসেছে। দেশে পাঁচ বছরের কম কৃশকায় (ওয়াসটিং) শিশুর হার ৮ শতাংশ। ২০১৪ ও ২০০৭ সালে তা ছিল যথাক্রমে ১৪ ও ১৭ শতাংশ।