বিস্ফোরণের পর হঠাৎ তৎপর কর্ণফুলী গ্যাস ও সিডিএ
চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় গ্যাসজনিত বিস্ফোরণ ও দেয়ালধসের পর হঠাৎ তৎপরতা বেড়েছে সরকারি সংস্থা কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)।
এ ঘটনায় কেজিডিসিএল তড়িঘড়ি তদন্ত শেষ করে বাসাবাড়ির গ্যাস-সংযোগের রাইজার পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যদিকে সিডিএ পাথরঘাটার ভবনগুলো ইমারত বিধিমালা মেনে নির্মিত হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার পরিকল্পনা নিয়েছে। এগুলো নিয়মিত কাজ হলেও দুটি সংস্থার এ ক্ষেত্রে চরম গাফিলতি ছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
রোববার সকালের এই দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত এবং অন্তত ১২ জন আহত হয়। ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের কমিটি গতকাল সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। একটি মামলাও হয়েছে।
বড়ুয়া ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস একটি নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছে। ভবনের সদস্যদের অন্যত্র চলে যেতে বলা হয়েছে।
কৌশল কেজিডিসিএলের
কেজিডিসিএলের তদন্ত কমিটির সদস্য সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক আ ন ম সালেক গতকাল ঘটনাস্থলে বলেন, ‘আমাদের গ্যাস থেকে ঘটনা ঘটেনি। এটা সেপটিক ট্যাংকের গ্যাস থেকে হতে পারে।’এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আবার বলেন, ‘দুর্ঘটনাস্থল প্রথম দিন পরিদর্শন করে আমরা চুলার নব খোলা পেয়েছি। ওই কারণেও গ্যাস বের হতে পারে।’
রোববার সকাল ৯টা ৪ মিনিটে বিস্ফোরণের ঘটনার পর সকাল ১০টায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে কেজিডিসিএল। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সন্ধ্যার মধ্যেই পেট্রোবাংলার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
তদন্ত কমিটির প্রধান প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক (প্রকৌশল ও সেবা) মো. সারোয়ার হোসেন গতকাল দাবি করেন, প্রাথমিক তদন্তে তাঁরা দেখেছেন, গ্যাস নিঃসরণের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেনি। কেননা, গ্যাসের রাইজার, পাইপলাইন ও রান্নাঘরের চুলা সব অক্ষত ছিল।
>
- পাথরঘাটায় বিস্ফোরণ
- কেজিডিসিএল দেড় লাখ গ্যাস রাইজার পরীক্ষা করবে
- পাথরঘাটার ভবনগুলোর নকশা যাচাইয়ের উদ্যোগ সিডিএর
অল্প সময়ের মধ্যে তদন্ত যথাযথ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে সারোয়ার হোসেন দাবি করেন, তদন্তে ত্রুটি রাখা হয়নি। তবে পেট্রোবাংলা বা মন্ত্রণালয় চাইলে আরও তদন্ত করতে পারে। যদিও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেন গতকাল ঘটনাস্থলে বলেন, গ্যাসের লাইন ছিদ্র হয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
গ্যাসের রাইজার পরীক্ষা করা হয় না
নিজেদের দায় নেই দাবি করলেও ঘটনার পর কেজিডিসিএল তড়িঘড়ি করে নগরের গ্যাস-সংযোগের রাইজারগুলো পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর আগে কখনো পরিকল্পনা করে রাইজার পরীক্ষার নজির সংস্থাটির নেই।
কেজিডিসিএলের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৯৮৫টি আবাসিক সংযোগ রয়েছে। ২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার সরবরাহ লাইন রয়েছে। মূল লাইন পরীক্ষা করা হলেও বাসাবাড়ির সংযোগ পরীক্ষা করা হয় না বলে জানান কর্মকর্তারা।
মহাব্যবস্থাপক মো. সারোয়ার হোসেন বলেন, সংযোগের জন্য গ্যাস রাইজার আছে প্রায় দেড় লাখ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের যে জনবল, তা দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব রাইজার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব নয়। তবে এই দুর্ঘটনার পর তাঁরা রাইজারগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
ঘুম ভেঙেছে সিডিএর
ইমারত বিধিমালা অনুসরণ করে ভবন নির্মিত হয়েছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব সিডিএর। এই সংস্থার অথরাইজড কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামীম প্রথম আলোকে বলেন, ওই এলাকার ভবনগুলো আগে খুব একটা তদারক করা হয়নি। তবে এখন সব ভবনের নকশা যাচাই-বাছাই করা হবে। ইতিমধ্যে তাঁরা কাজ শুরু করেছেন।
বিস্ফোরণস্থলের আশপাশের ভবনগুলো বসবাসের উপযোগী কি না, তা যাচাই করতে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সিডিএ।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয় সিডিএ। ভবন নকশা অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব ছিল সিডিএর। যদি নকশাবহির্ভূতভাবে কাজ হয়, তা নির্মাণের সময়ই দেখা দরকার ছিল। এই জায়গায় গাফিলতি ছিল তাদের।
শিক্ষা নেয় না কেজিডিসিএল
চট্টগ্রাম নগরে গত তিন বছরে অন্তত পাঁচ দফা গ্যাসজনিত বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এই ধরনের বিস্ফোরণে মারা গেছেন ১২ জন। নগরের পাথরঘাটার ব্রিক ফিল্ড রোডের ঘটনা ছাড়া অন্য চারটির কোনোটিতেই তদন্ত কমিটি গঠন করেনি কেজিডিসিএল।
তদন্ত কমিটি গঠন না করার বিষয়টি স্বীকার করে প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক (প্রকৌশল ও সেবা) মো. সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘ওগুলো সম্পূর্ণ গ্রাহকদের অভ্যন্তরীণ লাইনের কারণে ঘটেছে। সেখানে আমাদের দায়দায়িত্ব নেই। তাই কমিটি গঠন করা হয়নি।’
চুয়েটের সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গ্যাসলাইন যেনতেনভাবে করলে হবে না। ভূকম্পন কিংবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কী হবে, তা আগেভাগে চিন্তা করতে হবে। আর লাইন ও সংযোগ নিয়মিত পরীক্ষার দায়িত্ব কেজিডিসিএলের। এখানে তারা দায় এড়াতে পারে না।
তদন্তকাজ শুরু
জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ সময় তারা বড়ুয়া ভবনের নিচতলার বাসিন্দা মণি নাথ, তাঁর ছেলে অর্ণব নাথসহ বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেন।
দেয়াল ধসে পড়ার পর ঘরটি কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বৈদ্যুতিক পাখা বাঁকা হয়ে গেছে। ঘরের আসবাব ভেঙে গেছে।
তদন্ত দলের প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ জেড এম শরীফ হোসেন বলেন, তদন্তের সুবিধার্থে দলে সিডিএ এবং বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রতিনিধি রাখা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে দুর্ঘটনাটি গ্যাসজনিত কারণে ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে কী গ্যাস, বলা যাচ্ছে না।
মামলা
রোববারের ওই ঘটনায় গতকাল দুপুরে কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহত মাহমুদুল হকের (৪০) স্ত্রী শাহীনা আকতার বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় দুজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
কোতোয়ালি থানার ওসি মো. মহসীন বলেন, তদন্ত ও গ্রেপ্তারের স্বার্থে এজাহারনামীয় আসামির নাম বলা যাবে না।
এর আগে শাহীনা আকতার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তাঁর স্বামী রিকশাচালক মাহমুদুল হকের লাশ শনাক্ত করেন। এ নিয়ে সাতজনের পরিচয় পাওয়া গেল। মাহমুদুল হকের বাড়ি বান্দরবানে। তিনি স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে চাক্তাই ভেড়া মার্কেটের বস্তিতে থাকতেন।