ভোগান্তি কমাচ্ছে ভূমি ই-নামজারি
চাকরিজীবী মো. সালাহ উদ্দীন গত অক্টোবরে অনলাইনে জমির নামজারির আবেদন করেছিলেন। ২৮ দিনের মাথায় গত বৃহস্পতিবার এই নামজারি সম্পন্ন হয়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে এই চাকরিজীবী নামজারির কাগজ বুঝে নিতে এসেছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এক সহকর্মীর প্রতিনিধি হিসেবে তিনি অনলাইনে আবেদন করেছিলেন। এভাবে নামজারি এখন অনেক সহজ, আগের চেয়ে সময়ও কম লাগছে, ভোগান্তি নেই। তিনি বলেন, অনেকে নতুন প্রক্রিয়াটি জানেন না বলে দালাল ধরেন। এতে অর্থ খরচের পাশাপাশি ভোগান্তিও হয়।
‘চালু হলো ই-নামজারি, টাউট দালালদের মাথায় বাড়ি’ স্লোগান নিয়ে তিনটি পার্বত্য জেলা বাদে সারা দেশে গত ১ জুলাই চালু হয়েছে শতভাগ ই–নামজারি। ক্রয়সূত্রে বা অন্য কোনো উপায়ে জমির মালিক হয়ে থাকলে হালনাগাদ রেকর্ড সংশোধন করে নতুন মালিকের নামে জমি রেকর্ড করাকে নামজারি বলে। অনলাইনের মাধ্যমে নামজারি ই-নামজারি নামে পরিচিত।
যেকোনো স্থান থেকে অনলাইনে নামজারির আবেদন করা যায়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্ক্যান করে আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হয়। কেউ নিজে করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা এই আবেদন করে দিচ্ছেন। এরপর মুঠোফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে নামজারি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি জানানো হয়। নির্ধারিত শুনানির দিন সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে হাজির হতে হয়। নামজারি সম্পন্ন হলে সেটিও খুদে বার্তার মাধ্যমে জানানো হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়, ভূমি সংস্কার বোর্ড এবং সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের আওতাধীন অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) যৌথভাবে ই-নামজারি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ই-নামজারির ফলে ভূমি কার্যালয়ে সাধারণ মানুষের যাওয়ার হার কমবে। এ জন্য সেবা উন্নত করা হচ্ছে। ডিজিটাইজেশনের ফলে ভূমির দুর্নীতিও কমবে।
প্রায় ১০ লাখ ই–নামজারির আবেদন
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে ই-নামজারির পাইলট প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। সারা দেশে ৫০৮টি উপজেলা ও সার্কেল ভূমি কার্যালয় আছে। এগুলোর মধ্যে ৪৮৫টি উপজেলা ভূমি কার্যালয় ও সার্কেল কার্যালয়ে এবং ৩ হাজার ৬১৭টি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে ই-নামজারি বাস্তবায়িত হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৮১৫টি নামজারি আবেদন অনলাইনে হয়েছে। সনাতন পদ্ধতিতে ৪৫ দিনের মধ্যে নামজারি করা হতো। অনলাইনে ২৮ দিনের মধ্যে এই সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত সার্ভারে কিছু সমস্যা আছে। যেখানে ব্রডব্যান্ডের সংযোগ নেই, সেখানে কাজের গতি কিছুটা ধীর।
বগুড়ার ঠনঠনিয়া দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা আতিকুজ্জামান একখণ্ড জমি কিনে নামজারির জন্য অনলাইনে আবেদন করেছিলেন গত ২৮ জুন। মাসখানেকের মধ্যে নামজারি হয়েছে জানিয়ে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চিন্তাও করতে পারেননি, কোনো ঝামেলা ছাড়াই নামজারির কাজটি হয়ে যাবে। আগে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে দৌড়াতে হতো।
সম্প্রতি বাংলাদেশের ই–নামজারি নিয়ে গবেষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল। তারা ১৫৫টি উপজেলায় গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সনাতন পদ্ধতি এবং ই-নামজারি সেবার তুলনামূলক চিত্র নিয়ে গবেষণা করেন। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এই গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ই–নামজারি চালুর পর সেবাগ্রহীতাদের উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে সরাসরি আসার হার কিছুটা কমেছে। সনাতন পদ্ধতির তুলনায় এখন ১৭ শতাংশ কম যেতে হচ্ছে। ভূমি কার্যালয়ে সময় ব্যয় করার হার ৭ শতাংশ কমেছে। ই-নামজারির কাজে যুক্ত কর্মকর্তা–কর্মচারীদের দক্ষতাও বাড়ছে।
তবে কোনো কোনো ভূমি কার্যালয়ে ই–নামজারির জন্য ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সেবাগ্রহীতা প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইনে সেবা হলেও এখন পর্যন্ত ঘুষ বন্ধ হয়নি। তাঁর হয়ে ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা আবেদন করে দিয়েছেন। তিনি ৫ হাজার টাকা দিয়ে নামজারি করিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ঘুষ দিতে হলেও খুব কম সময়ে ও ঝামেলামুক্তভাবে নামজারি করতে পেরেছেন।
ঘুষ বন্ধ না হওয়ার কারণ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এখনো সবাই নিজে অনলাইনে আবেদন করতে পারেন না। তাঁরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ভূমি কার্যালয়ে যান। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অনলাইনে আবেদন করে দেন। সাধারণ মানুষ পুরোপুরি নিজে আবেদন করলে ঘুষ বন্ধ হয়ে যাবে। তবে নতুন পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষের অভ্যস্ত হতে কিছু সময় লাগবে।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রতিবছর দেশে প্রায় ৪২ লাখ ভূমি নিবন্ধন হয় এবং উত্তরাধিকারসূত্রে আরও ২০-২৫ লাখ নামজারির ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। কিন্তু মালিকানা হালনাগাদ হয় বছরে ৩০-৩৫ লাখ। প্রায় ৩০ লাখ ভূমি হস্তান্তর নামজারি/রেকর্ড হালনাগাদের বাইরে থেকে যায়। অনলাইনে এই সুবিধা চালু করার ফলে নামজারির পরিমাণ বাড়বে বলে মনে করছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
ভূমি সংস্কার ও অধিকার নিয়ে প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এলআরডি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ভূমি ই–নামজারির উদ্যোগটি ভালো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভোগান্তি ও দুর্নীতির হাত থেকে রক্ষা পেতে ডিজিটাইজেশনের বিকল্প নেই। তবে শুধু নামজারি নয়, সার্বিক ভূমিসেবার ডিজিটাইজেশন করতে হবে। এটি হয়তো সময়সাপেক্ষ। তবে ভূমিসেবা পুরোপুরি ডিজিটাইজেশন না হলে নামজারির বাইরে অন্য সেবাগুলো পেতে ভোগান্তি রয়ে যাবে।