রাজশাহী শহর আর শিশুবান্ধব নয়
এই তো বছর তিরিশ আগের কথা। রাজশাহী শহরে তখনো পাড়া পেরোলেই বিশাল বড় মাঠের দেখা মিলত। বিকেল হলেই সেখানে নেমে পড়তেন তরুণ, শিশু, বয়স্করা। তরুণ আর শিশুদের ব্যস্ততা খেলাধুলায়, বয়স্ক কেউ নীরবে হাঁটতে গিয়ে রোমন্থন করতেন ফেলে আসা তারুণ্যের স্মৃতি। কিন্তু সেই শহর এখন কংক্রিটের স্তূপ, যার প্রভাব পড়ছে মনের ওপরেও।
সেকালে রাজশাহী আর একালের রাজশাহী শহর নিয়ে তুলনা করতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন নগরীর সাহেব বাজার এলাকার বাসিন্দা মামুনুর রশিদ। প্রায় ষাটের ঘরে পৌঁছানো মামুনুর আরও বলছিলেন, ‘যে শৈশব আমরা এই শহরের পুরোনো অলিগলিতে ফেলে এসেছি, এখনকার প্রজন্ম তার ছিটেফোঁটাও পাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত যান্ত্রিক হয়ে যাওয়া শহরটায় নতুন প্রজন্মও বেড়ে উঠছে ভিন্ন রকম সংস্কৃতিতে। যে সংস্কৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছে শহরের আমূল পরিবর্তনটাই।’
মামুনুর রশিদের রোমন্থন করা সেই সাহেব বাজার গতকাল বুধবার ছিল যানজটে ঠাসা। বাজারের জিরো পয়েন্টে প্রতিনিয়ত উচ্চ শব্দে বেজে চলে যানবাহনের হর্ন। একটু হাঁক ছেড়ে ডাকলেও রাস্তার ওপারের মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা দায়। এই বাজারের পাশেই বড় মসজিদ চত্বর। কংক্রিটের দালানের চিপায় মানুষের ভিড়। ঐতিহ্যবাহী সোনাদিঘির মুখ দেখারই জো নেই। চিপা গলির ভেতরেই ১৪০ বছর বয়সী রাজশাহী নগরীর গণগ্রন্থাগারের নতুন ভবন উঠেছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গাগুলোতে যেন মানুষের দম আটকে আসে। হাইড্রোলিক হর্নে কানের পর্দা ফেটে যেতে চায়। একে একে ভরাট হয়ে যাচ্ছে জলাশয়গুলো। নেই খোলা জায়গা, খেলার মাঠ। এর মাঝেই নগরীর পাশের পদ্মা নদীর ধারের বিনোদনকেন্দ্রগুলো ছাড়া রাজশাহী শহরকে মামুনুর রশিদের মতো এখন আর কেউ শিশুবান্ধব বলতে রাজি নন।
খোদ রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র খায়রুজ্জামান যেমন বলছিলেন, ছেলেবেলায় তাঁরা অসংখ্য উন্মুক্ত খেলার মাঠ পেয়েছেন। নদীর ধারে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানোর জায়গা, বছরব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকত শহরে। ছিল ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দ। বিনা পয়সায় খেলার আয়োজন। সেটা স্কুলপর্যায়েও ছিল। এখন বাচ্চারা সেখান থেকে এসে ফেসবুকে আটকে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্মুক্ত জায়গা, সবুজ প্রাঙ্গণ, অখণ্ড নির্জনতা, নিরাপদ পানির নৈকট্য, সব জায়গায় নিরাপদ বিচরণের সুযোগ, পর্যাপ্ত বিনোদনকেন্দ্র—এগুলোই একটা শহরে শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্য আবশ্যক। কিন্তু এখনকার রাজশাহী শহর সে শর্ত কতটা পূরণ করছে?
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম আজাদ বললেন, একটি শহরে শিশুদের নিরাপদে সব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। বাচ্চারা পানির স্পর্শ পেতে পছন্দ করে। পানিতে যেন সে নিরাপদে নামতে পারে, সাঁতার কাটতে পারে। তার জন্য থাকতে হবে অখণ্ড নির্জনতা। এতে তার ভাবনার জগৎটা বড় হয়। এই শব্দদূষণের মধ্যে সে কিছু ভাবতে পারে না। তার জন্য সবুজ আঙিনা, খোলা মাঠ যেমন দরকার, তেমনি তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একতলা বা মাটিছোঁয়া হতে হবে। ওপরে উঠতে গেলে শিশুরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়। আর ভাড়াবাড়িতে তো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়াই উচিত নয়।
এই ভাবনা থেকে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের রাজশাহীর নকশা তৈরি করেছেন। গত বছরের ৩ জানুয়ারি তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রদর্শনীতে পরিকল্পিত রাজশাহী নগরীর ত্রিমাত্রিক মডেলের ছবি দেখিয়েছেন। যেখানে ছিল নগরের সব বয়সের মানুষের উপযোগী সুযোগ-সুবিধার বর্ণনা। প্রশস্ত রাস্তা, পরিকল্পিত আবাসন, খেলার মাঠে সব বয়সী মানুষের অবাধ চলাচলের সুযোগ—সবই ছিল ওই নকশায়।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র বলছেন, শহরে যে সুযোগ-সুবিধা আছে, সেগুলোকেই ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে হবে। যেখানে শহরের শিশুরা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবে। এ ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটা খেলার মাঠ তৈরি করা হবে।
মাঠ প্রসঙ্গে আবার কথা হলো সাহেব বাজারের বাসিন্দা মামুনুর রশিদের সঙ্গে। বললেন, ‘ছেলেবেলায় এই খেলার মাঠেই শুরু হতো বন্ধুত্বের। ছোট, সমবয়সী কিংবা জ্যেষ্ঠরাও খেলার ছলে বন্ধু হয়ে যেতেন। প্রতি বিকেলে খেলা শেষে তাঁদের সঙ্গেই মন খুলে গল্প হতো। কিন্তু এখনকার শিশুরা সে সুযোগ পাচ্ছে কই। যান্ত্রিকতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই শহরে মন খুলে সেই গল্প বলারও সুযোগ নেই। শহরের এই ঘিঞ্জি পরিবেশই যেন আর সে গল্প হতে দেয় না।’