ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সখ্য রাখতেন সেলিম প্রধান
অনলাইন ক্যাসিনোর মূল হোতা হিসেবে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার সেলিম প্রধানের নানা ধরনের ব্যবসা রয়েছে। নিজে সরাসরি রাজনীতি না করলেও তাঁর নিকটাত্মীয়রা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তবে ব্যবসার স্বার্থ রক্ষা করতে সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সেলিম প্রধানের ওঠাবসা ছিল। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে আগে কোনো মামলাও হয়নি বলে জানান তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা।
গত সোমবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটকের সময়ও ক্ষমতা ব্যবহার করে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন সেলিম।
সেলিম প্রধানের পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা মর্তুজাবাদ এলাকায়। এলাকায় তাঁদের বাড়িটি ‘মিয়া বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত।। সেলিম প্রধানের বাবা নান্নু মিয়া ভুলতায় একসময় কাপড়ের ব্যবসা করতেন। গতকাল বুধবার মর্তুজাবাদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেলিম প্রধানের বাবা একসময় ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। এর পর থেকে এলাকার সঙ্গে তাঁদের পরিবারের যোগাযোগ খানিকটা কম। নান্নু মিয়া তিন ছেলে, তিন মেয়ের জনক। ছেলেদের মধ্যে সেলিম তাঁর দ্বিতীয় সন্তান। নান্নু মিয়া ১৯৮৮ সালে তাঁর বড় ছেলে আলম মিয়াকে জাপান পাঠান। বড় ভাইয়ের মাধ্যমে সেলিম প্রধানও পরে জাপানে চলে যান। সেখানে তিনি পড়াশোনা ও কাজ করতেন। জাপানি এক নারীকে তিনি বিয়ে করেন।
মর্তুজাবাদে সেলিম মিয়ার প্রতিবেশীরা জানান, জাপানে থাকার সময় সেলিম প্রধান তাঁর ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন। পরে তাঁর ব্যবসার প্রসার আরও বাড়তে থাকে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার সাওঘাট এলাকায় সেলিম প্রধানের জেবি সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেলিম প্রধান ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া তিনি পি-২৪ নামে ল ফার্মেরও মালিক। পি-২৪ নামে অনলাইন ক্যাসিনোর জন্য একটি অ্যাপস রয়েছে। সেলিম প্রধানের ঘনিষ্ঠ জনেরা জানান, সেলিম প্রধানের চাচাতো ভাই আনোয়ার সাদাত সায়েম একসময় রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওই ভাই বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা। এই ভাইয়ের মাধ্যমে বিএনপি-চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকার সময় সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি।
গত ১ অক্টোবর সেলিম প্রধানের গুলশানের বাসায় অভিযান শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, কারাবন্দী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সেলিমের একসময় ভালো সম্পর্ক ছিল। তাঁকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়িও উপহার দিয়েছিলেন সেলিম।
ক্ষমতার পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেলিম প্রধানও নিজের সঙ্গী বদল করেন। সখ্য গড়েন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে। এই সম্পর্কের মাধ্যমে বৈধ ব্যবসার পাশাপাশি অবৈধ ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়েন সেলিম প্রধান। এর মধ্যে স্পা, ডিসকো ক্লাব গড়ে তোলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সাল থেকে অনলাইনে ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু করেন তিনি। অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার কারণে গত সোমবার দুপুরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থাই এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজের ভেতর থেকে আটক করে র্যাব। র্যাব সূত্র জানায়, র্যাবের হাতে আটকেরও সময়ও নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করেছিলেন সেলিম প্রধান। নিজেকে মুক্ত করার জন্য প্রভাবশালী এক নেতাকে ফোন করেন তিনি।
আটকের পর সেলিম প্রধানের গুলশান ও বনানীর অফিস এবং বাসায় অভিযান চালিয়ে ২৯ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা, ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকার সমপরিমাণ ২৩টি দেশের মুদ্রা, ১২টি পাসপোর্ট, ১৩টি ব্যাংকের ৩২টি চেক, ৪৮ বোতল বিদেশি মদ, একটি বড় সার্ভার, চারটি ল্যাপটপ ও দুটি হরিণের চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে। হরিণের চামড়া উদ্ধারের ঘটনায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ নিরাপত্তা আইনে তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই দিন রাতে সেলিম প্রধানকে কেরানিগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
মাদক ও অর্থ পাওয়ার কারণে সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে গতকাল বুধবার গুলশান থানায় র্যাবের পক্ষ থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও মানিলন্ডারিং আইনে দুটি মামলা করা হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে জানান র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) লে.কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারওয়ার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইন ক্যাসিনোর সঙ্গে সেলিম প্রধানের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তবে এখনো পর্যন্ত অন্যান্য ক্যাসিনোর সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: