পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা

চট্টগ্রাম নগরের আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কেটে গড়ে উঠছে রূপনগর আবাসিক এলাকা নামের বসতি। এখনো দুটি স্থানে পাহাড় কাটা চলছে। গত মঙ্গলবার বেলা দুইটায়।  ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রাম নগরের আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কেটে গড়ে উঠছে রূপনগর আবাসিক এলাকা নামের বসতি। এখনো দুটি স্থানে পাহাড় কাটা চলছে। গত মঙ্গলবার বেলা দুইটায়। ছবি: প্রথম আলো

এবড়োখেবড়ো পথ ধরে মিনিট দশেক চলার পর সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি কাঁচা সড়কের বাঁকে এসে থেমে গেল। কাদামাটি আর পানিতে একাকার। কাদা এড়াতে পাশের পাহাড় ডিঙিয়ে আবার কাঁচা সড়কে নামতে হলো। এলাকাটি শাপলা আবাসিক এলাকা নামে পরিচিত। হেঁটে আরেকটু ভেতরের দিকে গেলে চোখে পড়ে পাহাড় কেটে গড়ে ওঠা নতুন নতুন বসতি। এখনো থেমে নেই পাহাড় কাটা। নতুন এই আবাসনের নাম দেওয়া হয়েছে রূপনগর আবাসিক এলাকা। এটি চট্টগ্রাম শহরের প্রবেশমুখ সিটি গেট এলাকার পশ্চিমে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

এখনো দুটি জায়গায় পাহাড় কাটা চলছে। রুবি আকতার ও ফয়েজ আহমদ নামের দুজন নতুন করে দুটি প্রায় ৫০ ফুট উঁচু পাহাড় কাটছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এক মাস ধরে এই পাহাড় কাটা চলছে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ হওয়ার সুযোগ নিয়ে এখানে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠছে। জামাল উদ্দিন কনট্রাক্টর নামের এক ব্যক্তির ঘরের পাশেই পাহাড় কাটা চলছে। জামাল নিজেও তিন বছর আগে এখানে পাহাড় কেটে একতলা পাকা ঘর তুলেছেন। জামাল উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক।

পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর চারজনকে নোটিশ দিয়েছে। অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশগুপ্তা পাহাড় কাটার স্থান পরিদর্শন করে এসেছেন। এরপর অধিদপ্তরের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক সংশ্লিষ্টদের ৩০ সেপ্টেম্বর অধিদপ্তরের শুনানিতে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।

জানতে চাইলে অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশগুপ্তা বলেন, ‘এলাকাটি খুবই দুর্গম। বেশ কিছুদিন ধরে তারা পাহাড় কাটছে। অভিযোগের পর অনেক কষ্টে পাহাড় কাটার জায়গায় পৌঁছেছি। কিন্তু লোকজন ছিল খুব মারমুখী। পরিদর্শন করে কোনোরকমে চলে আসি। পরে নোটিশ করা হয়। পাহাড় কাটার বিষয়ে কোনো অনুমতি তাদের নেই।’

১৮ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে দেখা গেছে, জামাল কন্ট্রাক্টরের বাড়ির পাশে পাহাড় কেটে এক পাশ সমতল করে ফেলা হয়েছে। কাটা পাহাড়ের ছবি তুলতে দেখে এক মধ্যবয়সী লোক এগিয়ে আসেন। তিনি জানান, তাঁর নাম দুলাল মিয়া। কেন ছবি তোলা হচ্ছে জানতে চান তিনি। কারা পাহাড় কাটছে জানতে চাইলে দুলাল বলেন, ‘পোলাপাইন পাহাড় কাটছে।’

>

রূপনগর আবাসিক এলাকাটি বেশ দুর্গম
সেখানে বাড়িঘর নির্মাণের জন্য পাহাড় কেটে সমান করা হচ্ছে

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামালের বাসার সামনে যে পাহাড়টি কাটা হচ্ছে, সেটি রুবি আকতারের। এর কিছু দূরে ফয়েজ আহমদও পাহাড় কাটছেন। উত্তর পাহাড়তলী মৌজার দুটি জায়গা টিলা শ্রেণির। বিএস দাগ নম্বর ১৫৪। রুবি আকতারের পাহাড় কাটার দায়িত্ব নিয়েছেন ফিরোজ শাহ কলোনির মহিনউদ্দিন। ফয়েজ আহমদের পাহাড় কাটার ঠিকাদারি নিয়েছেন মহিনের ভাই শাহাবুদ্দিন। এই চারজনের নামে পরিবেশ অধিদপ্তর নোটিশ দিয়েছে। শাহাবুদ্দিনকে পুলিশ অন্য একটি মামলায় গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি এবং মহিনউদ্দিনের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে।

রুবি আকতার এলাকায় একটি সেলাইয়ের দোকান চালান। জানতে চাইলে রুবি বলেন, ‘আমি কোনো পাহাড় কাটছি না। রূপনগরে আমার জায়গা আছে। পাহাড় কে কাটছে জানি না।’

জানতে চাইলে আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দুর্গম এলাকাটির সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর সীমান্তে পড়েছে। বেশ কিছু পাহাড় পড়েছে সীতাকুণ্ডে। পাহাড় কাটার অভিযোগ পেলে সেখানে যেতে যেতে অপরাধীরা পালিয়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রূপনগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা এক বছর সাত মাস আগে গড়ে তোলেন রূপনগর সমাজ উন্নয়ন সমিতি নামে একটা সংগঠন। সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে আবু বক্কর ও আবু তালেব। জামাল উদ্দিন এই কমিটির অর্থ সম্পাদক। জামাল উদ্দিন নিজেও তিন বছর আগে টিলা কেটে এই ঘর নির্মাণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি পাঁচ বছর আগে এক ব্যক্তির কাছ থেকে জায়গা কিনেছি। তিন বছর আগে ঘর করেছি। ওটা পাহাড়ের পাশে সমতল জায়গা।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল প্রথম আলোকে বলেন, ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যায় না। টিলা কিংবা পাহাড় কাটতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি প্রয়োজন। এভাবে পাহাড় কাটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। পাহাড় কাটার জন্য যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা অবশ্যই দরকার। নইলে পাহাড় রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।