পানি-মাটি পরীক্ষায় জানা যাবে মাছের প্রজাতি
দেশে প্রথমবারের মতো ২৪৩ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছের জিনের তথ্যভান্ডার তৈরি হয়েছে। এর ফলে দেশের স্বাদু পানির মাছগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা যাবে। একই সঙ্গে কোন নদীতে কত প্রজাতির মাছ আছে, বাড়ল না কমল, তা আর গতানুগতিক উপায়ে গুনে গুনে জানতে হবে না। মাছের টিস্যু বা নদীর পানি বা মাটিতে থাকা মাছের ডিএনএ পরীক্ষা করেই তা জানা সম্ভব হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ এবং সুইডিশ ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের চারজন বিজ্ঞানী যৌথভাবে ওই তথ্যভান্ডার তৈরি করেছেন। বিশ্বের প্রভাবশালী বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার-প্রকাশনা গ্রুপের সায়েন্টিফিক রিপোর্ট সাময়িকীতে গত জুনে তাঁদের গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে।
সুইডিশ রিসার্চ কাউন্সিলের আর্থিক অনুদানে গবেষণা প্রকল্পটি তত্ত্বাবধান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান, অধ্যাপক আবদুর রব মোল্লা এবং সুইডিশ ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের কিউরেটর মাইকেল নরেন ও অধ্যাপক এসভেন কুলান্ডার। ২০১৩ সাল থেকে শুরু করা ওই গবেষণা চলতি বছর শেষ হয়েছে। তাঁরা দেশের বিভিন্ন নদ-নদী থেকে প্রায় তিন হাজার মাছের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাটি করেছেন।
গবেষণা প্রকল্পটির প্রধান সমন্বয়কারী মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথমবারের মতো একটি দেশের সব মাছের বিশেষ জিন সিকোয়েন্স ও সমন্বিত ডিএনএ তথ্যভান্ডার তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণসহ মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে দেশি প্রজাতির মাছ আজ হুমকির মুখে আছে। এ অবস্থায় দেশের স্বাদু পানির মৎস্য সম্পদের সংখ্যা ও বিস্তৃতি নির্ণয়ের জন্য জেনেটিক উপাত্ত সমৃদ্ধ একটি তথ্যভান্ডারের প্রয়োজন ছিল। এখন জিনের তথ্যভান্ডার বৈচিত্র্যময় স্বাদু পানির মাছ শনাক্তকরণ, পর্যবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রব মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জলসীমায় নতুন কোনো মাছ এল কি না বা কোনো মাছ বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেল কি না, তা আমরা এই তথ্যভান্ডারকে কাজে লাগিয়ে জানতে পারব। একই সঙ্গে সামগ্রিকভাবে দেশের মৎস্য সম্পদের সুরক্ষায় তা ব্যবহার করা যাবে।’
জিনোম হলো জীবের জিনগত বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। বংশগতির সব বৈশিষ্ট্যই এক বা একাধিক জিনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এসব বৈশিষ্ট্যের তথ্য জানার প্রাথমিক পদক্ষেপ হলো জিন নকশা উন্মোচন। গবেষণাটি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাণিদেহের বিশেষ বিশেষ জিনের নিউক্লিওটাইড প্রজাতি ভেদে ভিন্ন ভিন্নভাবে বিন্যস্ত থাকে। জিনের এ ধরনের স্বতন্ত্র বিন্যাস রূপকে বারকোড হিসেবে ব্যবহার করে প্রজাতি বা সংখ্যা শনাক্ত করা যায়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের মিঠাপানির মৎস্য সম্পদের উন্নয়নে ও টেকসই ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে এই গবেষণা আমাদের কাজে লাগবে। একই সঙ্গে দেশের মাছের বৈচিত্র্য ও আবাসস্থলের অবস্থা জানতে এবং তা সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও ওই তথ্যভান্ডার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
এসব বারকোড সিকোয়েন্স, ডিএনএ-সংক্রান্ত তথ্য ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন পরিচালিত জিন ব্যাংকে এবং সর্ববৃহৎ ডিএনএ বারকোড ডেটাবেইস বারকোড অব লাইফ ডেটাবেইসে জমা দেওয়া হয়েছে। যার ফলে ডিএনএভিত্তিক এ তথ্যভান্ডার দেশে নিবন্ধিত ও নতুন প্রজাতির মাছের বর্ণনা, বিপন্ন প্রজাতির অবস্থা ও বিস্তৃতি এবং বিদেশি ও আগ্রাসী প্রজাতি নির্ণয়ে ব্যবহার করা যাবে।
এ ব্যাপারে ওয়ার্ল্ড ফিশ বাংলাদেশ ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইকো ফিশ প্রকল্পের প্রধান অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব প্রথম আলোকে বলেন, পুষ্টিগুণের ভিত্তিতে মাছের বিভিন্ন গ্রুপ নিয়ে এবং মৎস্যজাত খাদ্যের উপাদান ও গুণাগুণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও এই তথ্যভান্ডার কাজে লাগানো যাবে।