কারবারির খোঁজ নেই, ইয়াবা ঢুকছেই
কক্সবাজারের টেকনাফে ইয়াবার ব্যবসা এখন করছেন কারা? অভিযানকারী চারটি বাহিনী ও একটি সংস্থার কাছে এর সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব নেই। এরই মধ্যে দ্বিতীয় দফা আত্মসমর্পণের তোড়জোড় চলছে। জেলা পুলিশ লাইনে ২৪ জনকে জড়ো করা হয়েছে।
মাদকবিরোধী কথিত বন্দুকযুদ্ধ চলছে আজ ১৫ মাস। এতে শুধু কক্সবাজারে নিহত হয়েছেন ১৪৮ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা মূলত মাদকের বাহক। প্রথম দফা আত্মসমর্পণ হয়েছে ছয় মাস আগে। ‘গডফাদার’ অনেকেই কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর জব্দ হওয়া ইয়াবার পরিমাণ বলছে, মাদকটির চালান এখনো অনেক।
চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি সরকারের দেওয়া সুযোগ নিয়ে মূলত টেকনাফের যে ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেছেন, তাঁরা এখন মোটামুটি নিরাপদ। তাঁদের ইয়াবাজাত সম্পদ অনুসন্ধান বা তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা এগোয়নি। ছোট-বড় অনেক ব্যবসায়ী যাঁরা আত্মসমর্পণ করেননি, তাঁদেরও ঝুঁকি তেমন দৃশ্যমান না।
জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণের জন্য সর্বোচ্চ সাতজন বড় ব্যবসায়ী এসেছেন। বাকিরা মাঝারি। প্রথম দফার মতো এবারও সমন্বয়কের ভূমিকায় আছেন উখিয়া-টেকনাফ আসনের সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান ওরফে বদি। প্রথম আলোকে এ কথা বলেছেন তিনি নিজে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গডফাদার তালিকার শীর্ষ এই ব্যক্তিত্ব এবারও আত্মসমর্পণ করেননি। এলাকায় চাউর আছে, তাঁকে আগলে রেখেই মাদকবিরোধী অভিযান চলছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেছেন, কোনোরকম পক্ষপাতের অভিযোগ অসত্য। অনেক অভিযোগই ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে অবাস্তব। এ অভিযানের প্রভাব ইতিবাচক। পথ বদলে এখন ভারতের ভেতর দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন—এই ছয় মাসে টেকনাফে চারটি বাহিনী ও একটি সংস্থা মিলে ৭৮ লাখের মতো ইয়াবা বড়ি জব্দ করেছিল বা পরিত্যক্ত পেয়েছিল। অভিযান চলাকালে এ বছরের প্রথম ছয় মাসে পাওয়া গেছে ৬০ লাখের কাছাকাছি বড়ি। এ হিসাব কক্সবাজার জেলা পুলিশের। বিজিবির নিজস্ব হিসাব আমলে নিলে অবশ্য দুটো সংখ্যাই বাড়বে।
কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেন ও টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াবা পরিমাণে আগের চেয়ে কম ঢুকছে। কিন্তু বিজিবির টেকনাফ অঞ্চলের অধিনায়ক ফয়সাল হাসান খান ও র্যাব ১৫-এর অধিনায়ক মো. আজিম আহমেদ বলেছেন, মাদকবিরোধী অভিযানের কোনো প্রভাব তাঁদের চোখে পড়ছে না। ইয়াবা আটক ও জব্দ হচ্ছে আগের মতোই। আর যতটুকু ধরা পড়ছে, তা চালানের ৫ থেকে ১০ শতাংশ মাত্র।
গত বছর মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কক্সবাজারে ৭৩ জন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী বা গডফাদারের তালিকা করেছিল, তাঁদের প্রায় সবাই টেকনাফের। আত্মসমর্পণ করেছেন তাঁদের মাত্র ২৯ জন। এঁদের ১৩ জনই বদির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তবে বদিসহ এ তালিকার ৩৫ জন আত্মসমর্পণ করেননি। বাদ বাকি ৯ জন মারা গেছেন, তাঁদের আটজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’।
এখন বদির মতো রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকা হাতে গোনা কয়েকজন গডফাদারকে মাঠে দেখা যায়। ২০১৪ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছোট–বড় মিলিয়ে কক্সবাজারে ১ হাজার ১০০–এর মতো মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা করেছিল। এঁরাও এখন মাঠে নেই।
>টানা অভিযানেও ইয়াবা চালান অপ্রতিহত
আবার আত্মসমর্পণের তোড়জোড়
পুলিশ লাইনে ২৪ জনকে জড়ো করা হয়েছে
গডফাদার অনেকেই কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে
গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে এলাকা ঘুরে পুলিশ, র্যাব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা বলেছেন, পুরোনো ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ এলাকার বাইরে থেকে ব্যবসা চালাচ্ছেন। কারও কারও লোকজন ব্যবসা ধরে রেখেছেন। কোথাও–বা আত্মসমর্পণকারীদের পরিবারের সদস্য বা ঘনিষ্ঠজনেরা কারবার করছেন। আত্মসমর্পণকারীরা নতুন করে ছয় শতাধিক মাদক কারবারির তথ্য দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য আর তথ্যদাতার নাম আসছে। বেশ কিছু সাধারণ ব্যবসায়ীও ইয়াবায় লগ্নি করছেন।
ব্যবসা কার হাতে?
কক্সবাজারে র্যাব ১৫-এর অধিনায়ক মো. আজিম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আবু বকর ও হাসান ওমর নামের দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করেছেন। তাঁদের সহোদর আবু তাহের অস্ত্র ও মাদক মামলার আসামি। ফেব্রুয়ারিতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যাওয়ার আগে তাহের তাঁর ওই দুই ভাইয়ের হাতে ইয়াবার কারবার দিয়ে এসেছিলেন। শাহজাহান আনসারী নামের এক ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করলে তাঁর কারবারের ভার নেন তাঁর বাকি তিন ভাই।
আত্মসমর্পণকারীরা জিজ্ঞাসাবাদে নতুন করে ৬৪৭ জন ইয়াবা কারবারির নাম বলেছেন। পুলিশ এই তালিকা তিন স্তরে যাচাই-বাছাই করেছে। জেলার এসপি মাসুদ হোসেন বলছেন, তাঁরা ৫৭ জন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে তালিকার কেউই এখন এলাকায় নেই।
র্যাব ১৫-এর অধিনায়ক মো. আজিম ও বিজিবির অধিনায়ক ফয়সাল হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েকজন বড় কারবারি এলাকা ছেড়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখান থেকে লোক মারফত তাঁরা কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া র্যাব কক্সবাজারের বড়বাজার আড়তের কয়েকজন ব্যবসায়ীকে শনাক্ত করেছে, যাঁরা ইয়াবার কারবারে টাকা খাটান।
টেকনাফ থানা বলছে, মাদকসহ তিনটি মামলার আসামি কোস্টগার্ডের অস্থায়ী চুক্তিপত্রভুক্ত মাঝি মো. মিজান কোস্টগার্ডের নৌকায় নাফ নদী দিয়ে ইয়াবা আনেন। তবে কোস্টগার্ডের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট হায়াত সিদ্দিক বলেছেন, এ অভিযোগ মিথ্যা।
সম্প্রতি বাহারছড়ায় হাবিবুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। স্থানীয় লোকজন বলছে, তিনি বিজিবি ও কোস্টগার্ডের তথ্যদাতা ছিলেন। পুলিশের দুজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, হাবিবুল্লাহ ফুল ও বাগান ব্যবসার আড়ালে ইয়াবার কারবার করতেন।
টেকনাফে বিজিবির একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, সম্প্রতি সাবরাং থেকে তাঁদের বাহিনীর এক সদস্যকে প্রত্যাহার করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি একজন ইয়াবা কারবারির চালান না ধরে ছেড়ে দিয়েছেন।
সাবেক সাংসদের ভূমিকা
এলাকার নানা স্তরের মানুষজন বলছেন, টেকনাফের বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা সাবেক সাংসদ বদির হাত ধরেই উঠেছেন। এখন তাঁদের সুরক্ষার জন্যও তিনি গুরুত্বপূর্ণ।
পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত সাইফুল করিমের মৃতদেহ টেকনাফে পৌঁছায় গত ৩১ মে বিকেলে। সেদিন বদি ছিলেন টেকনাফ থানায় পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইফতার মাহফিলে। ৭৩ গডফাদারের তালিকায় বদি আছেন এক নম্বরে, সাইফুল দুইয়ে।
সাইফুল করিম একাধিকবার সিআইপি (কমার্শিয়ালি ইমপরট্যান্ট পারসন) এবং কক্সবাজারের সর্বোচ্চ করদাতার স্বীকৃতি পেয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পারিবারিক সূত্রগুলো বলছে, মাদকবিরোধী অভিযানের সূচনায় সাইফুল মিয়ানমারে চলে যান। গত ২ মে পুলিশ তাঁর দুই ভাইকে আটক করলে সাইফুল দেশে ফিরে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।
র্যাবের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গত ২২ জুলাই প্রথম আলোকে বলেন, সাইফুল করিম মিয়ানমার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে তাঁকে বলেছিলেন, তিনি ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ইয়াবার কারবার করেছেন। তখনকার সাংসদ বদি আর তিনি একই সঙ্গে টেকনাফ স্থলবন্দরে ব্যবসা করতেন। র্যাবকে তিনি বড় ২৪ কারবারির নাম দেন।
সাইফুল গত ২৫ মে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসেন। মাসের শেষ দিনে তিনি নিহত হন। পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র প্রথম আলোকে বলেন, সাইফুল পুলিশের কাছেও একই কথা বলেছেন। পুলিশকে তিনি ৩৪ জনের নাম দেন। তিনি বলেন, বদি তাঁর ইয়াবা কারবারের সুবিধা নিয়েছেন। তাঁর দেওয়া একটি গাড়িতে বদি টেকনাফে ঘুরতেন।
তবে পরিবারের সদস্যরা গত ২১ জুলাই প্রথম আলোকে বলেছেন, আত্মসমর্পণের জন্য সাইফুল ‘এমপি সাবের’ বদলে একজন স্থানীয় সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এলাকার গণমান্য কয়েকজন ব্যক্তির মতে, সাইফুল আর বদির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল।
আবদুর রহমান ওরফে বদি ৩ আগস্ট মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এমপি ছিলাম। আমার সঙ্গে কত লোকেরই পরিচয় থাকতে পারে। আমি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে বলেছি সাইফুল করিমকে আটকানো না গেলে ইয়াবা বন্ধ হবে না।’
সাইফুল করিমের মা শামিম আরা প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমার ছেলে তো নাকি ডন ছিল! তাকে তো মেরে ফেলেছে। তাহলে ইয়াবা আসা বন্ধ হয় না কেন?’
সাইফুল নিহত হওয়ার পর মামলার বাদী পুলিশ কর্মকর্তা কিন্তু এজাহারে বদির সঙ্গে সাইফুলের সম্পর্কের কথা লেখেননি। তিনি লিখেছেন, সাইফুলের সঙ্গে ব্যবসায় বদির দুই ভাই মৌলভি মুজিব ও আবদুস শুক্কুর ছিলেন।
এর আগে ২০১৪ সালে অভিযানের সময় বিজিবি ও র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন বদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও টেকনাফ পৌরসভা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জাহেদ হোসেন ওরফে জাকু। এর পরপরই বদি লম্বা সময়ের জন্য ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। গত বছর মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর ১৫ দিনের মাথায় তিনি ওমরাহ পালন করতে যান। সাইফুল নিহত হওয়ার পর বদি চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলেন।
গডফাদারের তালিকায়
ইয়াবা কারবারি শনাক্ত করার ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ করেছেন নানা স্তরের মানুষজন। কক্সবাজারের এসপি মাসুদ হোসেন অবশ্য পক্ষপাতের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ১১ আগস্ট তিনি প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সাবেক সাংসদ বদির ছাড় পাওয়া সম্পর্কে এসপি মাসুদ বলেন, ওনার নাম তালিকায় ছিল। তবে তাঁর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
প্রথম দফা আত্মসমর্পণের আগে বাসায় এক বৈঠকে বদি ইয়াবা কারবারিদের তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণ করতে বলেছিলেন। সেখানে ছিলেন তালিকাভুক্ত শীর্ষ কারবারি টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ। সাইফুল করিম নিহত হওয়ার পর তিনি গা ঢাকা দেন। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেছেন, একই সময়ে বদির ভাই ও হেফাজতে ইসলামের নেতা মৌলভী মুজিবুর রহমান দুবাই চলে যান।
গডফাদারদের তালিকায় থাকা যে ৩৫ জন আত্মসমর্পণ করেননি, তাঁরা রাজনৈতিক নেতা বা জনপ্রতিনিধি। তাঁদের কেউ কেউ এখনো এলাকায় আছেন। যেমন, বদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলে পরিচিত বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ এবং সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভী রফিকউদ্দীন। তাঁরাসহ অন্তত পাঁচজন জনপ্রতিনিধি প্রথম আলোকে বলছেন, ‘দুশমনি’ করে তালিকায় তাঁদের নাম ঢোকানো হয়েছে। তাঁরা আত্মসমর্পণ করবেন না।
আত্মসমর্পণ ও ছাড়
প্রথম দফায় ১০২ জন আত্মসমর্পণকারীর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে মাদক আইনে একটি এবং অস্ত্র আইনে একটি মামলা করেছিল পুলিশ। একটিরও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। জেলার এসপি মাসুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আত্মসমর্পণের শর্ত ছিল এ দুটি মামলার বিষয়ে সরকার বিবেচনা দেখাবে। প্রতিদানে কারবারিরা মাদকবিরোধী অভিযানে সহায়তা করবেন।
এদিকে আত্মসমর্পণকারীদের ইয়াবাজাত সম্পদ অনুসন্ধানের বিষয়ে কারও কোনো হেলদোল নেই। গত বছর অভিযান শুরুর পর পুলিশ সাদাপোশাকে কমপক্ষে ৮০টি বাড়ি খননযন্ত্র দিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। পুলিশ অবশ্য বলেছিল, মানুষ খেপে গিয়ে এমনটা করেছে।
আত্মসমর্পণের পর কিন্তু আত্মসমর্পণকারীদের বাড়ি–সম্পত্তিতে কোনো অভিযান হয়নি। নাজিরপাড়া, জালিয়াপাড়া ও পল্লানপাড়ার বেশ কয়েকটি বাড়িতে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশ আর কোনো তল্লাশি করেনি। শুধু নাজিরপাড়ায় এজাহার মিয়া আর তাঁর দুই ছেলে নুরুল হক ভুট্টো ও নূর মোহাম্মদ ওরফে মংগ্রীর তিনটি বাড়ি পুলিশ আদালতের নির্দেশে জিম্মায় নিয়েছে।
সম্পদ অনুসন্ধান নিয়ে প্রথম থেকেই ধোঁয়াশা ছিল। আত্মসমর্পণের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এ কাজে যুক্ত হয়। তবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দাবি করে আসছে, এ কাজটি তাদের।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ৭০ জন ইয়াবা কারবারির তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করবেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দুজনের সম্পদের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছেন।
ওদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কক্সবাজার পুলিশের পদস্থ একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি আদালতের নির্দেশে বদির মামা মংমং সেনের বাসায় গিয়েছিলেন। এ সময় দুদকের একজন কর্মকর্তা তাঁকে ফোন করে বলেন, মংমংয়ের স্ত্রী খুব কান্নাকাটি করছেন, পুলিশ যেন আর না আগোয়। পুলিশ কর্মকর্তার প্রশ্ন, দুদক কেন অবৈধ সম্পদের পরিমাণ বলতে পারছে না।
কী করার আছে
একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, বাহিনীগুলো কেউ কারও সঙ্গে তথ্য আদান–প্রদান করে না। বিজিবির অধিনায়ক ফয়সাল হাসান খান জোর দিচ্ছেন বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ওপর। তিনি কক্সবাজার-টেকনাফের জন্য সব বাহিনীর প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটা বিশেষ বাহিনী গঠনের পরামর্শ দিচ্ছেন।
কক্সবাজারের সাবেক সাংসদ, সরকারদলীয় নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোহাম্মদ আলীও মনে করেন, একটা সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। প্রথম আলোকে তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সংস্থার করা ইয়াবা গডফাদার ও ব্যবসায়ীদের তালিকার অন্তত ১০ শতাংশ নাম ঠিক নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তালিকা ধরে কাজ করছে। কিন্তু একাধিক তালিকায় এক নম্বরে যাঁর নাম আছে, সেই বদির কিছু হলো না। সরকার খুব সম্ভবত তাঁকে ঘাঁটাতে চায় না।
সমন্বয়, সঠিক তালিকা—এগুলো জমি তৈরির কাজ। এলাকা ঘুরে মনে হলো, এখন অভিযান আর অব্যাহত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শুধু আতঙ্কই বাড়াচ্ছে। ইয়াবার কারবার বন্ধ হচ্ছে না।