অনিয়মিত ছাত্রদের নেতৃত্বে চলছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বেশির ভাগ নেতাই এখন আর নিয়মিত ছাত্র নন। অনেকে নানা পেশায় যুক্ত রয়েছেন। এ ছাড়া বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের জুলাইয়ে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এ কমিটির ‘কার্যকারিতা লোপ’ পেয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব ছাত্রনেতার কেউ কেউ সাত-আট বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) পাস করেছেন। তারপর ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকার জন্য অন্য কোনো বিষয়ে দ্বিতীয়বার স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়ে আছেন। অবশ্য এটা নেতৃত্ব ধরে রাখার পুরোনো কৌশল হিসেবে পরিচিত।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেবল ‘নিয়মিত’ শিক্ষার্থীরাই সংগঠনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদে থাকতে পারেন। আর অনূর্ধ্ব ২৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারবেন। গঠনতন্ত্রের ৫(গ) ধারায় বলা আছে, যেকোনো নিয়মিত ছাত্র ছাত্রলীগের কর্মকর্তা ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সদস্য হতে পারেন। তবে গঠনতন্ত্রে নিয়মিত ছাত্রের কোনো সংজ্ঞা দেওয়া নেই।
ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান একাধিক নেতা জানান, অতীতে লম্বা সময় অছাত্ররা সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন। নিয়মিত ছাত্রদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার লক্ষ্যে ২০০৬ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে নির্বাহী সংসদের সদস্যদের বয়সসীমা ২৯ বছর নির্ধারণ করা হয়।
ছাত্রলীগের ওয়েবসাইটে বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির ১৮১টি পদে দায়িত্বশীলদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়া ৩১ জন সহসভাপতি, নয়জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আটজন সাংগঠনিক সম্পাদকের নাম রয়েছে। তবে নির্বাহী সদস্যদের বিষয়ে ওয়েবসাইটে কোনো তথ্য নেই।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে পড়ালেখার দিক থেকে সর্বকনিষ্ঠ যিনি (একজন সাংগঠনিক সম্পাদক), তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তির শিক্ষাবর্ষ ২০০৭-২০০৮। ওই শিক্ষাবর্ষের প্রায় সব বিভাগের নিয়মিত শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে স্নাতকোত্তর শেষ করলেও তিনি এখনো শেষ করতে পারেননি। এই নেতা ছাড়া পদে থাকা আর কেউ এখন আর নিয়মিত ছাত্র নন। তবে তাঁদের কেউ কেউ বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিতীয় দফায় মাস্টার্সে (অনিয়মিত) ভর্তি হয়ে আছেন।
ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ২০০০-০১ শিক্ষাবর্ষে। নিয়মিত স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। এখন তিনি দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতকোত্তরে (অনিয়মিত) ভর্তি হয়ে আছেন।
সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির শিক্ষাবর্ষ ২০০৩-০৪ সাল। তিনি স্নাতক পাস করে আর স্নাতকোত্তরে ভর্তি হননি। ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) শেষ হয়েছে ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে। অবশ্য নাজমুল আলম দাবি করছেন, তিনি এখন একটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ক্যাম্পাসে আইন বিষয়ে ভর্তি আছেন।
ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেহেদী হাসান (২০০২-০৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি) ও সাধারণ সম্পাদক ওমর শরীফও (২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি) এখন আর নিয়মিত ছাত্র নন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
অবশ্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দাবি, তাঁদের কমিটির বেশির ভাগই নিয়মিত ছাত্র।
‘নিয়মিত ছাত্রের’ সংজ্ঞা জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান বলেন, তাঁদের বিবেচনায়, বয়স ২৯ বছরের মধ্যে এবং যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি থাকলে তাঁরা নিয়মিত ছাত্র।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) সহিদ আকতার হুসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা অনার্স ও মাস্টার্সে পড়ছেন, তাঁরাই কেবল নিয়মিত ছাত্র। যাঁরা একটি বিষয়ে মাস্টার্স করার পর অন্য কোনো বিষয়ে আবার মাস্টার্স বা প্রফেশনাল কোর্স, শর্ট কোর্স, এমফিল, পিএইচডি করছেন তাঁদের নিয়মিত ছাত্র ধরা হয় না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১১ সালে গঠিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকে ইতিমধ্যে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২০১২ সালে পাঁচজন সহসভাপতিসহ ১৪ জন কেন্দ্রীয় নেতার চাকরি হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থায় (এনএসআই)। এরপর আরও অনন্ত ছয়জন যোগ দিয়েছেন বিসিএস ক্যাডারে, তিনজন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা আরও অন্তত ১৮ জন বিভিন্ন চাকরি, ব্যবসা বা ঠিকাদারি পেশার সঙ্গে যুক্ত। দুজন এবার উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা হিসেবে দাপট খাটিয়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে।
কমিটির আকার: গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ হওয়ার কথা ২৫১ সদস্যের। কিন্তু বর্তমান কমিটি যখন গঠিত হয়, এতে ঠাঁই পেয়েছিলেন ২২১ জন। এরপর গত বছরের এপ্রিলে আরও ২৭২ জনকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু সংগঠনটির ওয়েবসাইটে কমিটির বিভিন্ন পদধারী ১৮১ জনের নাম উল্লেখ আছে। তবে এতে নির্বাহী সদস্যদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। প্রথম আলোর কাছে কমিটির যে তালিকা আছে, তাতে ১৩১ জন নির্বাহী সদস্যের নাম রয়েছে।
বর্তমান কমিটি আসলে কত সদস্য বিশিষ্ট? এ প্রশ্নের জবাবে সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, এগুলো কাগজ দেখে বলতে হবে। তবে বর্তমান কমিটি কমবেশি ২২১ থেকে ২৩০ সদস্যের হবে।
মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি: ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ১১(খ) ধারায় বলা আছে, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কার্যকাল দুই বছর। এর মধ্যে সম্মেলন করে নতুন কমিটি করতে হবে। অন্যথায় নির্বাহী সংসদের কার্যকারিতা লোপ পাবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে বর্ধিত সভায় অনুমোদন সাপেক্ষে কমিটির মেয়াদ তিন মাস বাড়ানো যাবে।
কিন্তু বর্তমান কার্যনির্বাহী সংসদ হয়েছিল ২০১১ সালের ১০ জুলাই। গত বছরের ৯ জুলাই এ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর বর্ধিত সভা করে কমিটির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। এ অবস্থায় এ কমিটির কার্যকারিতা আছে কি না, জানতে চাইলে সভাপতি বদিউজ্জামান দাবি করেন, পরবর্তী কমিটি না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান কমিটি বহাল থাকবে, এটাই ছাত্রলীগের ঐতিহ্য।
অবশ্য সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম জানান, উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের পর ঢাকা মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল করা হবে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করা হবে।