চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পঞ্চমবারের মতো নগর ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথম চারবারই ভবন করতে ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। এবার ২৫ তলা ভবন তৈরিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০২ কোটি টাকা। ২০১০ সালে যখন প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তখন প্রকল্প ব্যয় ছিল ৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ নয় বছরের ব্যবধানে খরচ বেড়েছে ১৫০ কোটি টাকা।
সরকারি তহবিলে ভবন নির্মাণের একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুমোদনের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু গতবার এই ভবনের জন্য অর্থ দিতে রাজি হয়নি মন্ত্রণালয়। তাই এই ভবন আদৌ হবে কি না তা নিয়ে এবারও সংশয় রয়েছে।
করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, প্রায় ৫০ কাঠা জায়গার ওপর নতুন নগর ভবন নির্মাণ করা হবে। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালের জুনে শেষ হবে। বর্তমান ছয়তলা ভবনটি ৫৫ বছরের পুরোনো।
সাবেক ও বর্তমান মেয়রের চার উদ্যোগ ব্যর্থ
সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নগর ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। স্থাপত্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান প্রণয়নকে দিয়ে নতুন নগর ভবনের নকশা তৈরি করা হয়। ২৫ তলা ভবনের জন্য নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১০০ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এই ভবন নির্মাণ করার কথা ছিল। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এতে সায় দেয়নি।
দুই বছর আগে ২০১৭ সালে নগর ভবন, সেবক কলোনি ও বিভিন্ন সড়কের উন্নয়নে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয় সিটি করপোরেশন। ওই প্রকল্পের একটি অংশ ছিল দেড় শ কোটি টাকা ব্যয়ে নগর ভবন নির্মাণ। তবে ওই প্রকল্প থেকে নগর ভবন নির্মাণের জন্য অর্থ–সহায়তা দিতে রাজি হয়নি মন্ত্রণালয়। মূল প্রকল্প থেকে নগর ভবন নির্মাণ বাদ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে নগর ভবন বাদ দিয়ে করা প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার।
নগর ভবন নির্মাণে ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ চেয়ে গত বছর ৫ আগস্ট তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে চিঠি দিয়েছিলেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। কিন্তু কোনো বরাদ্দ মেলেনি।
২০১০ সালের ১১ মার্চ ২০ তলা বিশিষ্ট নগর ভবনের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর করেছিলেন তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ জে কনস্ট্রাকশনকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ভিত্তিপ্রস্তরের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তখন নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৬ কোটি টাকা। কিন্তু ওই বছরের ১৭ জুন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোহাম্মদ মনজুর আলমের কাছে পরাজিত হন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এরপর নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে এই ভবন নির্মাণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছিল না। এ ছাড়া আর্থিক জটিলতাও ছিল।
সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম মেয়াদের শেষ সময়ে এসে নগর ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্মাণকাজ শুরু হয়। কিন্তু চার মাস পর আবার বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনে আ জ ম নাছির উদ্দীনের কাছে হেরে যান।
নগর ভবনের ইতিহাস
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৬৩ সালে যাত্রা শুরু করা চট্টগ্রাম পৌরসভা ১৯৯০ সালে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়। ১৮৬৩ সালে একটি ও ১৯৬৪ সালে আরেকটি ভবন নির্মাণ করা হয়। এই দুটি ভবনেই করপোরেশনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। তবে অত্যন্ত জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় ১৮৬৩ সালে নির্মিত ভবনটি ২০০৯ সালে ভেঙে ফেলা হয়। এখন খালি জায়গাটিতে গাড়ি রাখা হয়। ছয়তলা ভবনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম চলছে। এই ভবন ভেঙে নতুন নগর ভবন নির্মাণ করা হবে।
একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিভিন্ন জটিলতায় নগর ভবন নির্মাণ করা যায়নি বলে জানান সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা। তিনি বলেন, এবার অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে ইতিবাচক মনোভাব জানানো হয়েছে। তাই তাঁরা আশাবাদী। নগর ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হলে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম নগরের টাইগারপাসে নির্মিত বস্তিবাসীদের ভবনে স্থানান্তর করা হবে বলে জানান মো. সামসুদ্দোহা।
সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, আগে নগর ভবনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও মন্ত্রণালয়ে কোনো ডিপিপি পাঠানো হয়নি। আর তৎকালীন মন্ত্রী ভবন নির্মাণে টাকা দিতে মৌখিকভাবে রাজি হননি। তবে অর্থায়নের ব্যাপারে বর্তমান মন্ত্রী ও সচিব মেয়রকে ইতিবাচক সমর্থন দিয়েছেন। তাই প্রকল্প অনুমোদনে জটিলতা নেই।
মেয়র পদে পরিবর্তন এবং পরিকল্পনাগত ও আর্থিক সংকটের কারণে নগর ভবন নির্মাণে আগের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলে মনে করছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের জন্য নগর ভবন হওয়া দরকার। কিন্তু বর্তমান আর্থিক অবস্থার কারণে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিলে এই ভবন নির্মাণ সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারি–বেসরকারি সহযোগিতা লাগবে।