সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ শুরু
চোখ-কান সতর্ক রেখে বাঁ হাতে দা ও ডান হাতে থাকা লাঠি দিয়ে ঝোপঝাড় আর লতাপাতা সরিয়ে এগোতে থাকেন সাজোনি (দলপতি) আজিবার রহমান। তাঁর পেছনে নিশ্বাস ফেলা দূরত্বে এক হাতে দা ধরা কাটুনি বাবলে (গাছে উঠে চাক কাটতে নির্ধারিত ব্যক্তি) জহুরুল ইসলাম আরও সতর্ক। সামনের দুজনকে অনুসরণ করে আড়িয়ালা (হাঁড়ি অথবা পাতিল ধরা ব্যক্তি) কেরামত আলী এগোতে থাকেন সমানতালে।
এভাবে মিনিট ত্রিশের পথ চলার পর কাটুনি বাবলে জহুরুল ইসলাম ‘আল্লাহ আল্লাহ’ চিৎকার দিতেই দাঁড়িয়ে যান সবাই।
সাজোনির দেখানো পথ ধরে এগিয়ে আসা দ্বিতীয়, তৃতীয় আড়িয়ালা ও তাঁদের দুই সহকারীসহ সবাই একত্র হন। দলের সপ্তম সদস্য (ভর লেইয়ে) নৌকা পাহারার দায়িত্বে থাকলেও কড়চালক (দিক নির্ণয়ক) জাহিদ হোসেনের সংকেত পেয়ে সমবেতরা তৈরি হয়ে যান বছরের প্রথম মৌচাক কাটতে।
লতাপাতা দিয়ে তৈরি কাড়ুতে (চাকে ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়ানোর কাজে ব্যবহৃত) আগুন জ্বালিয়ে চাকের নিচে ধোঁয়া দিতে শুরু করেন মনিরুল ও জবেদ আলী। সাজোনিকে পাহারার দায়িত্বে রেখে মুহূর্তের মধ্যে প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতায় থাকা চাকের কাছে পৌঁছে যান কাটুনি বাবলে জহুরুল। নিচে দাঁড়িয়ে ধামা (বেত দিয়ে তৈরি পাত্রবিশেষ) পেতে সমদূরত্ব থেকে আসা মৌচাক ধরে নেন আড়িয়ালা কেরামত আলীসহ সঙ্গী দুজন। আধা ঘণ্টারও কিছু বেশি সময় নিয়ে প্রথম চাক সংগ্রহের পর একইভাবে দলটি এগিয়ে চলে নতুন মৌচাকের সন্ধানে।
গত সোমবার সকাল ১০টার দিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন এলাকায় আনুষ্ঠানিকতা শেষে অন্যদের মতো সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা দেয় সিংহড়তলী গ্রামের মৌয়াল দলটি। মালঞ্চ নদীতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা নৌকা চালিয়ে বেলা তিনটার দিকে ফিরিঙ্গির চরে পৌঁছায় তারা।
দলনেতা আজিবার রহমান জানান, প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ করে ১৪ দিনের চালান নিয়ে তাঁর ৭ সদস্যের দলটি সুন্দরবনে ঢুকেছে। মধু মৌসুম শুরুর আগে কমবেশি বৃষ্টি হওয়ায় বিগত বছরের তুলনায় এবার বেশি মধু সংগ্রহের প্রত্যাশা তাঁর।
আজিবারের মতো ইউনুস গাজী, শামছুর রহমান ও আশরাফ গাজীসহ আরও অনেক মৌয়াল দল মধু মৌসুমের শুরুতে সাতক্ষীরা রেঞ্জ দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকেছে। সোমবার সকালে বন বিভাগের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাঁরা প্রত্যেকে সুন্দরবনের নির্ধারিত গন্তব্যের উদ্দেশে লোকালয় ছাড়েন। প্রথম দফায় পাস নিয়ে বনে ঢোকা এসব মৌয়াল দল আগামী ১৪ দিন সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করবে।
বরাবরের মতো এ বছরও প্রতিটি দলে ৭ থেকে ১৪ জন মৌয়াল রয়েছেন বলে জানান দাতিনাখালী গ্রাম থেকে আসা দলের সাজোনি সামছুর রহমান। তাঁর অভিযোগ, এবারও তিনটি বনদস্যু দলকে ৪০ থেকে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে বনে ঢুকতে হয়েছে। তিনি বলেন, বাঘের উপদ্রব কমলেও বনদস্যুদের হাত থেকে রেহাই মিলছে না। মধু সংগ্রহের পাস নেওয়ার আগেই বনদস্যুদের নির্ধারিত চাঁদা পরিশোধ করে বিশেষ ‘রসিদ’ নিতে হয়।
চাঁদনীমুখা গ্রাম থেকে মধু সংগ্রহে আসা দলটির প্রধান আমির আলী বলেন, অনুমতি থাকার পরও প্রতিবার ফিরে পাস সারেন্ডারের সময় বনরক্ষীদের ‘নজরানা’ হিসেবে কিছু মধু দিতে হয়।
দাদনের টাকার সুদ ও বনরক্ষীদের নির্ধারিত ‘নজরানা’ পরিশোধ আর বনদস্যুদের চাহিদা মিটিয়ে মধু সংগ্রহের বিষয়টি বাঘের মোকাবিলা করার চেয়ে ভয়ংকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুন্দরবনে চলতি মৌসুমের মধু সংগ্রহ আনুষ্ঠিকভাবে সোমবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে। সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক জি এম রফিকুল আহমেদের সভাপতিত্বে মধু সংগ্রহ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন সংরক্ষক বশিরুল-আল-মানুন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন শ্যামনগর উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আতাউল হক, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহাসিন উল মুলক, গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম ও বুড়িগোয়ালিনী ইউপি চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মণ্ডল।
বক্তারা মধুর গুণাগুণ উল্লেখ করে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে যাতে সুন্দরবন ধ্বংস না হয়, সেদিকে মৌয়াল ও বন বিভাগকে বিশেষ খেয়াল রাখার আহ্বান জানান।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন কর্মকর্তা মো. কবিরউদ্দিন জানান, মধু সংগ্রহ চলবে ১ এপ্রিল থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত। চলতি মৌসুমে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৫০ কুইন্টাল আর মম ২৬৫ কুইন্টাল।