ছাত্রদের ফেলে যেতে চাননি জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষ দিনগুলোয় যেকোনো সময় হামলার আশঙ্কা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাও নিজের পরিচিতজন, বিশেষ করে ছাত্রদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলেছিলেন। তাঁকেও অনেকে বলেছিল একই কথা।
অধ্যাপক জ্যোতির্ময়কে পাকিস্তান সরকার সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখত বরাবরই। একে হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছেন, তার ওপর বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পত্রিকায় কলাম লেখা বা রেডিওর অনুষ্ঠানে যাওয়া তাঁর জন্য প্রায় নিষিদ্ধ ছিল।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরের যেসব জায়গা পাকিস্তান বাহিনী তাদের নৃশংস হামলার মূল লক্ষ্যকেন্দ্র করেছিল, তার একটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল। আর অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ছিলেন এই হলের প্রাধ্যক্ষ।
আক্রমণের আশঙ্কার মধ্যে স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে জ্যোতির্ময় বলেন, ‘সবাই আমাকে সাত দিন দূরে থাকতে বলছে। আমি হলের প্রভোস্ট। আমি কী করে ছাত্রদের ফেলে যাব? ওদের জন্যই তো এ কোয়ার্টার আমাকে দিয়েছে, ফোন দিয়েছে। আমি জানি, কিছু হলে আমাকেই আগে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।’
সেই কালরাতের বর্ণনা দিয়েছেন বাসন্তী গুহঠাকুরতা, ইউপিএল থেকে প্রকাশিত তাঁর একাত্তরের স্মৃতি বইয়ে। অধ্যাপক জ্যোতির্ময় থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার আবাসিক এলাকায় ৩৪ নম্বর ভবনের নিচতলায়। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত দুইটার দিকে রান্নাঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে এক পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা।
শোয়ার ঘরে গিয়ে জ্যোতির্ময়কে অফিসার বলে, ‘আপ প্রফেসর সাহাব হ্যায়?’ জ্যোতির্ময় দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘ইয়েস’। অফিসার বলে, ‘আপকো লে যায়েগা।’ একইভাবে জ্যোতির্ময় জিজ্ঞেস করেন, ‘হোয়াই?’
এই ‘কেন’র উত্তর মেলেনি। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে হিড়হিড় করে টেনে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। একই ভবনের তিনতলা থেকে নেওয়া হয় পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক এ এন এম মুনীরউজ্জামানকেও।
একটু পরপর আটটা গুলির শব্দ হলো। অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের স্ত্রী সৈয়দা মাহমুদা জামান নিচে নেমে দেখেন, জ্যোতির্ময়ের দেহে প্রাণ আছে। তাঁর ঘাড়ে ডান দিকে গুলি করেছে। শরীর অবশ।
মাহমুদা জামান বাসন্তীকে ডেকে আনেন। কাছেই ঢাকা মেডিকেল। কিন্তু কারফিউর কারণে তখন নেওয়া গেল না। ২৭ তারিখে ভর্তি হলেন জ্যোতির্ময়। কিন্তু ঘাড় থেকে বুলেট বের করা গেল না।
৩০ মার্চ রাতে অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন।