ইতিহাস যেখানে কথা বলে
>• ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের যাত্রা শুরু
• দুই হাজারের বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও পুঁথিপত্র আছে
• আছে গ্রন্থাগার ও প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী সংরক্ষণ গবেষণাগার
শাহবুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ জাহান। সম্রাট শাহ জাহান নামে পরিচিত তিনি। ১৬২৮ থেকে ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছেন। সম্রাট শাহ জাহানের শাসনকালে যেসব কামান ব্যবহার করা হয়েছিল, তার একটি স্থান পেয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরে।
‘সার জং’ নামের ওই কামান ১৬৫৬ সালে এক যুদ্ধে ব্যবহারও করা হয়। ১৯৭ সেন্টিমিটার লম্বা সুনিপুণ কারুকার্যখচিত মোগল অস্ত্রটি দেখে যেকোনো দর্শনার্থীই মুগ্ধ হবেন। শুধু এই কামান নয়, এটি ছাড়াও জাদুঘরে স্থান পেয়েছে কয়েক হাজার প্রাচীন ও ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং আধুনিক শিল্পকর্মের সংগ্রহ।
১৯৭৩ সালের ১৪ জুন ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর। শুরুতে চারটি কামান ও ২৪টি পুরাকীর্তি ছিল জাদুঘরের সম্বল। তবে বর্তমানে রয়েছে দুই হাজারের বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও দুষ্প্রাপ্য পুঁথিপত্র। ইতিহাসের নানা বাঁক যেন থমকে আছে এখানে।
যা আছে জাদুঘরে
দোতলাবিশিষ্ট জাদুঘরে ঢুকতেই চোখে পড়বে সমকালীন শিল্পী ঢালী আল মামুনের একটি শিল্পকর্ম। ‘লাট সাহেবের চেয়ার ও মহারানির মুকুট’ শিরোনামের এই শিল্পকর্ম জাদুঘরকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি এর মধ্য দিয়ে শিল্পী ইতিহাসের মধ্যে দর্শককে যেন টেনে আনতে চেয়েছেন।
জাদুঘরের মূল কক্ষের প্রবেশদ্বারে রয়েছে প্রাচীন শিলালিপি, দোতলা ভবনের নিচতলায় দেখা মিলবে আরও কিছু চিত্রকর্ম। এক পাশে রয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কর্নার। সেখানে স্থান পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছবি।
এ ছাড়া রয়েছে গ্রন্থাগার ও প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী সংরক্ষণ গবেষণাগার। গবেষণাগারের নাম রাখা হয়েছে গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের নামে। বাঙালি ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করার জন্য এই গ্রন্থাগারে রয়েছে ৪ হাজারের বেশি বই। এ ছাড়া রয়েছে দুই হাজার দলিলপত্র। দর্শন, শিল্প-সাহিত্য, জাতিতত্ত্ববিদ্যা ও প্রাচীন লিপি বিজ্ঞানসহ আরও নানা বিষয়ে গবেষকেরা তথ্য খুঁজে পাবেন গ্রন্থাগারটিতে।
জাদুঘরের ওপরতলায় রয়েছে ৫টি গ্যালারি। প্রত্নতত্ত্ব ও প্রাগৈতিহাসিক, ইসলামিক শিল্পকলা, লোকশিল্প, সমকালীন চিত্রকলা ও ভাস্কর্য নামের এসব গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে নানা মূল্যবান সংগ্রহ। প্রত্নতাত্ত্বিক গ্যালারিতে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে নানা ধরনের পুরাকীর্তি। পাশাপাশি এ গ্যালারিতে রয়েছে প্রাচীনকালের চিত্রকর্ম, জীবাশ্ম ও মাটির মূর্তি। শুরুতে তেমন কিছু সংগ্রহে না থাকলেও এখন অনেক সমৃদ্ধ এই গ্যালারি।
ভাস্কর্য গ্যালারিতে রয়েছে ১১ শতকে পাওয়া কষ্টিপাথরের মনসার মূর্তি। ১৯ শতকের পাওয়া শিবের মূর্তিও আগ্রহ জাগাবে দর্শনার্থীদের। এ ছাড়া আরও রয়েছে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালের বিষ্ণুমূর্তি, শিবলিঙ্গ, গণপতির মূর্তি প্রভৃতি। এই গ্যালারিতে শোভা পেয়েছে ৫২টি পাথর ও ২৫টি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য।
লোকশিল্প গ্যালারিতে দেখা মিলবে তাঁতের তৈরি জিনিসপত্র, চরকা, পালকি, শত বছরের পুরোনো অলংকার। রয়েছে প্রাচীন নকশা দিয়ে সাজানো ঢেঁকি ও কাঠের নৌকা। পাশাপাশি রয়েছে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের তামা, মাটির পুতুল, পিতল ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, মাটির ভাস্কর্য, বেতের ঝুড়িসহ আরও কত কী। এই গ্যালারিতে বাংলার লোকশিল্পের ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়েছে।
ইসলামিক শিল্পকলা গ্যালারিটি আরও বৈচিত্র্যময়। সুলতানি ও মোগল আমলের কামান, ৪০০ বছরের পুরোনো হাতে লেখা কোরআন যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে মধ্যযুগের পুঁথি, দলিলদস্তাবেজ ও মুদ্রা। এই গ্যালারিতে আরও রাখা হয়েছে মধ্যযুগের অস্ত্র, ক্যালিগ্রাফি ও প্রাচীন মসজিদের ছবি।
সমসাময়িক চিত্রকলা গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে বরেণ্য শিল্পী জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, মুর্তজা বশীর, নিতুন কুন্ডু, শাহ মো. আনসারি রশীদ চৌধুরীসহ বিখ্যাত শিল্পীদের তেলচিত্র।
জাদুঘরের বর্তমান পরিচালক ভূঁইয়া ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯২ সালের ১০ আগস্ট কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পশ্চিমে স্থায়ীভাবে জায়গা পায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর। এটি বর্তমানে দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জাদুঘর। এখানকার প্রাচীন নিদর্শনগুলো দেশি–বিদেশি গবেষকদের কাজে লাগছে।
জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ঘুরে ঘুরে দেখছেন জাদুঘরের গ্যালারিগুলো। এ সময় হালিমা-তুস-সাদিয়া নামে সংগীত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া এমন অনেক কিছুই এই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। এখানে বিভিন্ন রকমের সংগ্রহ দেখে তিনি মুগ্ধ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, জাদুঘরে যে সংগ্রহ রয়েছে, তা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহশালার চেয়ে সমৃদ্ধ। এ কারণেই জাদুঘরটি শিক্ষার্থী ও গবেষকদের নজর কেড়েছে।