'কুলু' ঘোরে, রস বের হয়
ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। চারপাশে আবছা অন্ধকার। কুয়াশায় মোড়া গ্রাম। মনু নদের বুক থেকে মেঘের মতো জলের ধোঁয়া উড়ছে। মনু নদের এপারে-ওপারে শীতের স্তব্ধ সকাল। তখনো গ্রাম জেগে ওঠেনি। তবে কিছু মানুষ কর্মচঞ্চল। মৌসুমি ফসল ও ফসলকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে তারা সরব।
গতকাল সোমবার সকালে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার মনু নদের ভাঙারহাট খেয়াঘাটে তখনো খেয়ানৌকা চালু হয়নি। মাঝি আসতে আসতে সূর্যের লাল রং সাদা হয়ে উঠছে। একপর্যায়ে খেয়া পার হলে ওপারে উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের মিটিপুর গ্রাম। অনেকটা এলোমেলোভাবে শিশিরভেজা পথ, সদ্য ধান কেটে নেওয়া নাড়ার মাঠ পার হয়ে পাওয়া গেল মুসলিম মিয়ার বাড়ি। মুসলিম মিয়া সহকর্মীদের নিয়ে আখ মাড়াই করছেন। তিনি এখনো আখমাড়াইয়ের পুরোনো ধারাটি ধরে রেখেছেন। একটি মহিষের চোখে ঠুলি বেঁধে সেই মহিষকে আখমাড়াইয়ের কলের চারদিকে ঘোরাচ্ছেন। আর একজন মেশিনের ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছেন খেত থেকে কেটে আনা টুকরা টুকরা আখ। সেই আখ থেকে রস নির্দিষ্ট পাত্রে গিয়ে জমা হচ্ছে। সেই রস ছোট-বড় পাত্রে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রেতারা। নয়তো তা চুলায় রাখা কড়াইয়ে গুড় তৈরির জন্য ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। বাড়ির পাশেই জমিতে ও মনু নদের চরে আখের খেত। সেখান থেকে অনেক আখ কেটে নিয়ে আসা হয়েছে। আখের গোড়া এখনো পড়ে আছে। স্থানীয়ভাবে অনেকে এই আখমাড়াইয়ের যন্ত্রটিকে ‘কুলু’ নামেই চেনেন।
স্থানীয় লোকজন জানালেন, একসময় মনু নদের পাড়ঘেঁষা এই মিটিপুরসহ আশপাশের গ্রামে প্রচুর আখ চাষ হয়েছে। শীত এলে পাড়ায় পাড়ায় আখমাড়াইয়ের ধুম পড়েছে। আখের রস দিয়ে তৈরি ক্ষীর ও পিঠাপুলির কদর ছিল ঘরে ঘরে। আমন ধান ঘরে তোলা শেষে হাতে অবসর। আত্মীয়-কুটুমের বাড়িতে অনেকেই আখের রসের পিঠা তৈরি করে পাঠাতেন। সেই ভোরের আগেই শুরু হতো আখমাড়াই। যাঁদের খেত আছে কিন্তু কুলু নেই, তাঁরা যাঁদের আছে তাঁদের কাছে নিয়ে আসতেন। এ ক্ষেত্রে কেউ নিজেরাই আখমাড়াই কলের হাতল টেনে আখ থেকে রস কুড়িয়েছেন। তবে বেশির ভাগই ছিল মহিষ দিয়ে আখমাড়াই। কিন্তু কালের যাত্রায় আখ চাষ ও আখ থেকে রস আহরণের সনাতন এই পদ্ধতি অনেকের কাছেই এখন স্মৃতি। মহিষ দিয়ে আখমাড়াইয়ের পুরোনো পদ্ধতিটা এখনো ধরে রেখেছেন মুসলিম মিয়া। তিনি আর কোনো ফসল চাষ করেন না। আখই তাঁর সারা বছর চলতে উপার্জনের উৎস।
মুসলিম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক আগে থাকিই আমরার এলাকায় আখ চাষ অইতো (হতো)। আমি নিজেই ২০-২৫ বছর ধরি খেত কররাম। আমার মইষর (মহিষের) মেশিন আছে। নিজেরও আখ পেরি (মাড়াই করি)। অন্যেরও পেরি। আমার আর কোনো কিচ্ছু নাই। ওটা দিয়াই (এসব দিয়েই) কোনো রকম সংসার চালাই। গাঙে (মনু নদ) ৫-৬ কিয়ার (বিঘা) জমি নিয়া গেছে। সরকার থাকিও কোনো সহযোগিতা নাই।’ অপর আখচাষি মজই মিয়া বলেন, ‘আমার মেশিন নাই। খেত করি। যার মেশিন আছে, তার কাছে আনি কুইয়ার (আখ) পেরাই (আখমাড়াই)।’
স্থানীয় আখচাষিরা জানালেন, কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত আখের রস বিক্রি করতে পারেন তাঁরা। এক লিটার আখের রস ২৫ থেকে ৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা টিনে করে এই রস নিয়ে ছড়িয়ে পড়েন জেলার বিভিন্ন এলাকায়। তাঁরা মৌসুমি কারবারি। আখের মৌসুমটিতে তাঁরা এই রস বিক্রি করেই জীবিকা চালান। দুপুরের আগেই তাঁরা রস বিক্রি করে বাড়ি ফেরেন। আবার গ্রামের অনেকে ছোট ছোট পাত্র নিয়ে আখমাড়াই যন্ত্রের কাছে এসে হাজির হয়েছেন। তাঁরা ৫-১০ লিটার, যাঁর যা প্রয়োজন নিয়ে যাচ্ছেন। তবে মুসলিম মিয়া আখের রস পাইকারি বিক্রি করেন না। তিনি নিজেই রস দিয়ে গুড় তৈরি করেন। ২০ লিটার রসে তিন থেকে চার কেজি গুড় তৈরি হয়। কোনো প্রকার কৃত্রিমতা না থাকায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এই গুড়ের চাহিদা আছে। এই গুড় ৭৫ থেকে ৯০ টাকায় তাঁরা বিক্রি করেন।
খুচরা বিক্রেতা আবদুল গনি বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে রস নিয়া যাই। বিক্রি করি দুপুরের দিকে চলে আসি। কোনো রকম লাভ দিয়ে চলে আর কী।’
রাজনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই এলাকায় আখের চাষ ব্যাপক আকারে নেই। ছোট পরিসরে গুড়ের জন্য স্থানীয় কৃষকেরা আখ চাষ করে থাকেন। এই অঞ্চলে আখ চাষে সরকারি কোনো প্রণোদনা নেই। সব মিলিয়ে এই উপজেলায় আট একরের মতো আখ চাষ হয়ে থাকে।