'কুমিরভাই' হয়ে ওঠার গল্প

কুমির জীবনের ৮০ শতাংশ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। মুখ হাঁ করে চোখ খোলা রেখেও ঘুমাতে পারে। মা কুমির বাসা বানায় পেছনের পা দিয়ে। জন্মের সময় কুমিরছানার ওজন ৬০ থেকে ৭০ গ্রাম হলেও ৩০ বছর বয়সে ওই কুমিরের ওজন হয় এক টন। দৈর্ঘ্যে ৫ থেকে ৬ মিটার লম্বা হয়। ফেসবুকে শুধু কুমিরের তথ্যই নয়, কুমিরের ছবি দিয়েই চলে ফেসবুকের বন্ধুদের গুড মর্নিং জানানো। শুভ সন্ধ্যা বা দৈনন্দিন কোনো স্ট্যাটাসেও নিজের বা পরিবারের সদস্যদের ছবির চেয়ে কুমিরের ক্যারিকেচার করা ছবিরই প্রাধান্য।
এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে মানুষকে দোষ দেওয়ারও উপায় নেই। যে ব্যক্তির জীবন কুমিরময়, তাঁকে তো ‘কুমিরভাই’ ডাকাই যায়। এই কুমিরভাই হলেন মুশতাক আহমেদ। তিনি দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির চাষের উদ্যোক্তা। সম্প্রতি ‘কুমির চাষির ডায়েরি’ নামের একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর।
মুশতাক আহমেদের জন্ম চুয়াডাঙ্গায়। ১৯৮০ সালে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। ১৯৮৯ সালে চাকরিজীবন শুরু করেন চা–বাগানে। বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যে পড়াশোনার সুবাদে উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সের বিভিন্ন খামার ও কৃষি কার্যক্রমের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে। দেশে ফিরে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেন। তবে ১৯৯৬ সালে সিদ্ধান্ত নেন উদ্যোক্তা হবেন। তারপরও ইন্টারনেটভিত্তিক টেলিফোন সেবা কোম্পানিতেও চাকরি করেন। ২০০১ সালে বোট ম্যানেজার হিসেবে একটি ট্যুর অপারেটিং কোম্পানিতে কাজের সুবাদে কাছ থেকে দেখেন সুন্দরবনকে। তবে তখনো মাথায় আছে ‘কিছু’ করবেন। অবশেষে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে প্রথম কুমিরখামার শুরু করলেন। ২০১০ সালের ৪ জুন বাংলাদেশ থেকে তাঁর হাত ধরেই প্রথমবারের মতো কুমির রপ্তানি হয়। এর পাশাপাশি ভ্রমণ ও ছবি তোলার শখ তো আছেই।
প্রথম আলো কার্যালয়ে বসেই কথা হয় এই কুমিরচাষির সঙ্গে। হাসতে হাসতেই বললেন, এখন অবশ্য কেউ আর কুমিরচাষি বলে না, বলে কুমিরভাই। কুমিরকে ভালোবাসেন, তাই এ নিয়ে তেমন একটা আপত্তিও করতে পারেন না।
ভালুকার ‘রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড’ হলো দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমিরখামার। কাজ শুরুর পর থেকেই এ নিয়ে গবেষণা বা অন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকেই সবকিছু টুকে রাখতেন মুশতাক। নিজের অভিজ্ঞতা এবং টুকে রাখা তথ্যের ভিত্তিতেই প্রথম বই প্রকাশ। মালয়েশিয়াতে ৬০–এর দশকে শুরু হওয়া কুমিরের খামারে প্রজনন হয় ১৯৮১ সালে। ২০০৪ সালে সেখান থেকে কুমির এনেই ২০০৬ সালে প্রজনন শুরু করে এবং বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেওয়া কুমির প্রজনন শুরু করে ২০১৬ সালে।
বাংলাদেশে মুশতাক আহমেদের আগেও কয়েকজন কুমির চাষের উদ্যোগ নেন, তবে সফল হননি। মুশতাক আহমেদের প্রকাশক স্বরে-অ–এর সিইও আবু বকর সিদ্দিকও বই প্রকাশে উৎসাহী হন মুশতাক আহমেদের ফেসবুকের পোস্ট দেখেই। ১০৮ পৃষ্ঠার বইটিতে কুমির চাষের ভাবনা থেকে শুরু করে প্রথম রপ্তানি পর্যন্ত বর্ণনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির কুমির, বাণিজ্যিক কুমির চাষসহ বিভিন্ন তথ্য এবং চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছেন। বইয়ে খামার গড়ে তোলার পেছনে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং বিশেষ করে সাউথ এশিয়ান এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট ফ্যাসিলিটিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন মুশতাক আহমেদ। অনুমতি পেতে দুই বছরে ৩২টি টেবিল ঘুরে আসাসহ বিভিন্ন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও উল্লেখ করেছেন।
মুশতাক আহমেদ কুমিরের খামার প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি যে পাগল ছিলাম না, তা প্রমাণ করতেই লেগেছে আট বছর বছর।’ দেশের প্রচলিত আইনের মধ্যে থেকে ৬৭টি কুমির রপ্তানির মাধ্যমে পরে মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হন যে তিনি পাগল ছিলেন না। বইয়ে মুশতাক আহমেদ বলেন, শুরুতে অনেকেই বলতেন, কুমির-টুমির কিছু না, ব্যাংকের টাকা মারার ফন্দি এটি। তারপর বলতেন, কুমির বাঁচবে না, বাঁচলেও ডিম পাড়বে না। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পর শুনতে হয়েছে, এগুলো বিক্রি হবে না। জার্মানির হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে কুমির কেনার প্রস্তাব পাওয়ার পর শুনতে হয়েছে, এরা ভুয়া।

২০০২ সালে সুন্দরবনে পরিচয় হয় রিতা আলমের সঙ্গে। কুমিরের গল্প শোনানোর জন্যই মুশতাক আহমেদ রিতা আলমের বাসায় যান। আর সেখানেই পরিচয় রিতার বন্ধু মাসিহা আখতার লিপার সঙ্গে। রিতা ও লিপা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। রিতা হলেন ঘটক, আর লিপা শুধু কুমির চাষেই আগ্রহী নন, কুমিরচাষিকেই বিয়ে করেন। ২০০৫ সালে বিয়ের পর থেকে মুশতাক আহমেদ স্ত্রী লিপাকে কুমির চাষে ‘নলেজ ব্যাংক’ হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। এই কুমির চাষের পেছনে সময় ব্যয় করার কারণেই লিপা নিজের চাকরিজীবনে ইস্তফা দিয়েছিলেন। বিয়ের আগেই লিপা মুক্তা চাষ, ইলিশ মাছের প্যারাসাইট নিয়ে গবেষণা করতেন। নতুন একটি পরজীবী শনাক্ত করেছিলেন, যা আন্তর্জাতিক জার্নালে ছাপাও হয়েছিল। প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে মুশতাক আহমেদ কথা বলার সময় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্ত্রীর নাম নিলেন একাধিকবার। মুশতাক আহমেদ বইটি উৎসর্গ করেছেন বাবা-মা এবং স্ত্রী লিপাকে।
কিন্তু নিজের হাতে গড়া কুমিরখামারের সঙ্গে এ দম্পতি যুক্ত থাকতে পারেননি। ২০১৩ সালে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করে দেন খামার। ৭৫টি কুমির দিয়ে খামারের যাত্রা শুরু করলেও হস্তান্তরের সময় কুমিরের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৫০০। মুশতাক আহমেদ আক্ষেপ করেই বললেন, ‘বর্তমানে কুমিরভাই ডাক শোনা, কুমিরবিষয়ক একটি বইয়ের মালিক হওয়া ছাড়া আর কোনো অর্জন নেই আমার।’
নিজের মামা কুমির চাষে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন, আবার এই মামার সঙ্গে মান-অভিমানসহ বিভিন্ন কারণেই খামারের কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হন মুশতাক আহমেদ। তবে ওই অধ্যায়টুকু নিয়ে কথা বলতে ততটা আগ্রহী নন মুশতাক আহমেদ। বইতেও কুমির রপ্তানির দিনটি পর্যন্ত লিখেই ইস্তফা টেনেছেন।
মুশতাক আহমেদ বলেন, ‘কুমির নিয়ে পড়াশোনা বা পরিকল্পনার মাত্র ১৫ শতাংশ ভালুকায় খামারে বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি পরিকল্পনা মাথায় আছে। কুমির নিয়ে খামার করার পাশাপাশি একটি বিশ্বমানের চিড়িয়াখানা করার ইচ্ছা আছে। বই প্রকাশের দিন কুমির নিয়ে নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দেওয়া স্ত্রীর মুখে হাসি দেখেছি, তা নতুন করে আশা জাগিয়েছে।’
কুমির ব্যবসায় কেউ উদ্যোক্তা হতে চাইলে তাঁদের জন্য মুশতাক আহমেদ বলেন, এ ব্যবসায় ‘শর্টকাট’ কোনো পদ্ধতি নেই। ব্যবসা শুরুর পর কমপক্ষে ১০ বছর হাতে রাখতে হবে। অবকাঠামোতে বিশাল বিনিয়োগ লাগবে। তবে কোনো উদ্যোক্তা লেগে থাকলে সফল হবেনই। এ ব্যবসায় ঝুঁকি নেই। অন্যান্য ব্যবসার মতো হরতাল-অবরোধেও তেমন কোনো সমস্যা হয় না। কেননা, নয় মাস কুমিরকে সপ্তাহে এক দিন খাবার দিতে হয়। আর তিন মাস কোনো খাবারই দিতে হয় না। ডাইনোসরের যুগ থেকেই কুমিরের তেমন কোনো পরিবর্তন বা বিবর্তন হয়নি। রোগবালাই নেই বললেই চলে। ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচে কুমির। চায়না, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে কুমিরের মাংসের বিশাল চাহিদা আছে। চামড়ার চাহিদা তো আরও বেশি। তবে কুমিরের ব্যবসায় হিসাব-নিকাশে গন্ডগোল হতে পারবে না। কুমিরের চামড়ার জন্য কুমিরের বয়স তিন বছরের বেশি হলেই তা আর কাজ করবে না।