যাত্রীর চাপ সামাল দিতে ডেমু ট্রেন চালিয়ে এখন রেলওয়েই বিরাট চাপে পড়েছে। এই ট্রেনে যাত্রী পরিবহন করে পাঁচ বছরে রেলের আয় ১৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর খরচ ২৫ কোটি টাকা। লাভ-ক্ষতির এই অঙ্ক শুনে রেলওয়ের বেসামাল অবস্থায় পড়ার বিষয়টি অনেকেই মানতে চাইবেন না। তাঁদের জন্য তথ্য হচ্ছে, ৬৫৪ কোটি টাকা দিয়ে মাত্র পাঁচ বছর আগে চীন থেকে কিনে আনা ২০ সেট ডেমু ট্রেনের ১১ সেটই এখন নষ্ট।
মেরামত করে নষ্ট হয়ে যাওয়া ডেমু ঠিক করা যাবে এমনটা যাঁরা ভাবছেন, তাঁদের জন্যও দুঃসংবাদ রয়েছে। রেলের কর্মকর্তারাই বলছেন, নষ্ট হওয়া ডেমু দেশে ঠিক করার মতো ব্যবস্থা নেই।
মাত্র পাঁচ বছরে বেশির ভাগ ডেমুর ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাওয়াকে অস্বাভাবিক ঘটনা বলেই মনে করেন রেলের প্রকৌশলীরা। তাঁরা বলেন, সাধারণত রেলের ইঞ্জিনের গড় আয়ু থাকে ২৫ বছর। আর বগির ক্ষেত্রে তা ২০ বছর। মেরামত করে ইঞ্জিন ও বগি আরও কয়েক বছর চালানো যায়।
ডেমু ট্রেনের দুই দিকে দুটি ইঞ্জিন এবং মাঝখানে একটি বগি থাকে। বগির পাশাপাশি ইঞ্জিনেও যাত্রী বহন করা যায়। অর্থাৎ, দুই ইঞ্জিন এবং এক বগি নিয়েই এক সেট ডেমু। সব মিলিয়ে এক সেট ডেমুতে বসে ১৪৯ জন এবং দাঁড়িয়ে ১৫১ জন যাত্রী যাতায়াত করতে পারে। এর বেশি যাত্রী উঠলেই ডেমু অকেজো হয়ে যায়। তাই প্রথম দিকে গুনে গুনে ডেমুতে যাত্রী ওঠাতেন রেলের কর্মীরা।
ট্রেনে করে দ্রুত শহরতলির মানুষ যাতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের মতো বড় শহরে প্রতিদিন যাতায়াত করতে পারে, সেই লক্ষ্যে ডেমু আমদানি করেছিল রেলওয়ে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের অধীনে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের মধ্যে প্রথম ডেমু ট্রেন চালু করা হয়। ডেমু স্বল্প দূরত্বে (সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার) চলাচলের উপযোগী হলেও ২০১৩ সালের মে মাসেই চট্টগ্রাম-লাকসাম রেলপথে এই ট্রেনে যাত্রী পরিবহন শুরু হয়। এই পথের দূরত্ব প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। পর্যায়ক্রমে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলেও (পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল—এ দুই ভাগে বিভক্ত বাংলাদেশ রেলওয়ে) ডেমু চালু করা হয়।
রেলের কর্মকর্তারা বলেন, ডেমু যেসব পথে চলছে, তার মধ্যে ঢাকা-জয়দেবপুরের দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার, ঢাকা-টঙ্গী ২২ কিলোমিটার, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ ৯০ কিলোমিটার, সিলেট-আখাউড়া ১৭৬ কিলোমিটার, ঢাকা-আখাউড়া ১২০ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা ১৫৫ কিলোমিটার, নোয়াখালী-লাকসাম ৪৮ কিলোমিটার, লাকসাম-চাঁদপুর ৪৯ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট ৩৭ কিলোমিটার, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট ৭১ কিলোমিটার এবং পার্বতীপুর-পঞ্চগড়ের দূরত্ব ১৩২ কিলোমিটার।
রেলের প্রকৌশলীরা জানান, রাজনৈতিক বিবেচনায় এক বিভাগীয় শহর থেকে অন্য বিভাগীয় শহরে ডেমু চালানো হয়। কিন্তু একটানা দীর্ঘ পথ চালানোর জন্য ডেমু উপযুক্ত নয়। গত বছরের শেষের দিকে একে একে ১১ সেট ডেমু বিকল হয়ে যায়।
রেলের বাণিজ্যিক বিভাগ সূত্র জানায়, পূর্বাঞ্চলে ১৮ সেট ডেমু পরিচালনা করে ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আয় হয় ১৭ কোটি ৩৫ লাখ ৫৮ হাজার ৬৫২ টাকা। একই সময়ে মোট ৮১ লাখ ৪৭ হাজার ২৭০ যাত্রী পরিবহন করা হয়। পশ্চিমাঞ্চলে ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ১০ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৮ যাত্রী পরিবহন করে ডেমু ট্রেন থেকে রেলের আয় ২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৩৪ টাকা।
রেলের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেমু পরিচালন খরচ প্রায় ২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জ্বালানির জন্য বেশির ভাগ ব্যয় হয়েছে। লোকোমাস্টারের (ট্রেনচালক) বেতন-ভাতা ও টিকিট বিক্রিতে জনবলের খরচ এর সঙ্গে যুক্ত।
এত দ্রুত ডেমু ট্রেন কেন নষ্ট হলো, তা জানতে রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে রেলের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, নীতিগত কিছু ভুলের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আসলে স্বল্প দূরত্বে চালানোর জন্য ডেমু কেনা হয়েছিল। ৬৫৪ কোটি টাকা বিনিয়োগের কী হবে—এই প্রশ্নে রেলের মহাপরিচালক স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। একই প্রশ্ন আবার করা হলে তিনি বলেন, ডেমু ট্রেন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেশে কোনো ওয়ার্কশপ (মেরামত কারখানা) নেই। নষ্ট হওয়া ডেমু ট্রেন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নারায়ণগঞ্জে একটি ওয়ার্কশপ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।
তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের আগ্রহে চীন থেকে ডেমু ট্রেন কেনা হয়। তখনই রেলের কিছু কর্মকর্তা এর বিরোধিতা করেছিলেন।
রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক পদমর্যাদার সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, ডেমুর টাকা দিয়ে ১৩০টি এসি বগি কেনা যেত। বগি কেনা হলে স্টেশনে টিকিটের জন্য হাহাকার কমত। একটি এসি বগি থেকে বছরে আড়াই কোটি টাকা আয় হয়। ডেমুতে বিনিয়োগের দায় রেলের তৎকালীন প্রশাসন এড়াতে পারে না।