‘মারিব মৎস্য খাইব সুখে।’ টেলিভিশন বিজ্ঞাপন দেখে রাজনীতিবিদদের একটি অংশ মৎস্য খাওয়ার সুখে নয়, কর ফাঁকি দিতে রাতারাতি মৎস্যজীবী হয়ে উঠেছে।
একতরফা দশম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন এমন ২৮ জনের আয়ের অন্যতম উৎস মৎস্য চাষ। পাঁচ বছর আগেও এঁদের ১৭ জনের মাছ ধরার এই ব্যবসা ছিল না। এখন আছে কাগজে-কলমে, বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই।
সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের হলফনামা আকারে আয়-ব্যয়ের আট ধরনের তথ্য দিতে হয়। সেই হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও সাংসদদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রাতারাতি মৎস্যজীবী হয়ে উঠেছেন। গত পাঁচ বছরে ২৮ ‘মৎস্যজীবী’ মন্ত্রী-সাংসদের আয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে।
আয়ের উৎস হিসেবে মৎস্য খাত আগে ছিল, এখনো আছে—এমন প্রার্থীদের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেছে, তাঁদের খামার আছে নামমাত্র।
আয়কর আইনজীবী এবং দীর্ঘদিন ধরে মৎস্য চাষের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৎস্য খাতে বিনিয়োগ আসলে একটা কৌশল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, কালোটাকা দেখানোর বড় খাতই হলো মাছ চাষ। কারণ, ৩ শতাংশ আয়কর দিলেই আয় বৈধ হয়ে যায়।
মাছ ব্যবসার শীর্ষে আছেন ঢাকার সাংসদ শেখ ফজলে নূর তাপস। এরপর মাদারীপুর থেকে নির্বাচিত সাংসদ নূর-ই-আলম চৌধুরী, ঢাকার ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ, চট্টগ্রামের দিদারুল আলম ও এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী এবং খুলনার তালুকদার আবদুল খালেক। আরও আছেন, গত পাঁচ বছরে ‘আলাদিনের চেরাগ’ পাওয়া সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ সহকারী মাহবুব উল আলম হানিফ।
মৎস্য খাতে সাংসদদের বিনিয়োগকে চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে তুলনা করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জনগণের ভোটে জিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের স্বার্থকে ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছে। শুধু মৎস্য খাতের এই অনিয়মকে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশন এসব সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
মৎস্যজীবী বড় রাজনীতিবিদ: কথিত মাছ চাষে সম্পদ অর্জনের তালিকায় শীর্ষে আছেন শেখ ফজলে নূর তাপস। হলফনামায় মৎস্য খাত থেকে ১২ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার ১২৩ টাকার সম্পদ দেখিয়েছেন তিনি। এই খাত থেকে তাঁর স্ত্রীর নামে সম্পদ দেখিয়েছেন এক কোটি দুই লাখ ৭০ হাজার ৫৪৪ টাকা।
নবম সংসদ নির্বাচনে দেওয়া হলফনামায় মৎস্য খাতে ফজলে নূর বা তাঁর স্ত্রীর কোনো আয় ছিল না। এ বিষয়ে কথা বলতে তাঁর মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী তারেক শিকদার ফজলে নূরের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বলেন, তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর নামে টুঙ্গিপাড়ায় মৎস্য খামার রয়েছে। তবে টুঙ্গিপাড়ার কোন স্থানে বা কী পরিমাণ জমিতে এই খামার রয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি তিনি।
যোগাযোগ করা হলে গোপালগঞ্জ জেলা মৎস্য কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলায় বড় ধরনের পোনা উৎপাদনের কোনো হ্যাচারি নেই। ব্যক্তি খাতে মাছ চাষে ফজলে নূর তাপসের কোনো বিনিয়োগ সম্পর্কে দপ্তরে কোনো তথ্য নেই। তিনি জানান, বছরে এক কোটি টাকা আয় হয় এমন আকারের মৎস্য খামারও এ এলাকায় থাকা অসম্ভব।
এ খাতে দ্বিতীয় শীর্ষ আয় মাদারীপুর-১ থেকে নির্বাচিত সাংসদ নূর-ই-আলম চৌধুরীর। হলফনামায় তিনি দেখিয়েছেন, চিংড়ির ঘের ও শেয়ার ব্যবসা থেকে তাঁর আয় আট কোটি ৮৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা। এই খাতে তাঁর নির্ভরশীলদের আয় তিন কোটি ৯৭ লাখ টাকা। অথচ ২০০৮ সালে এই খাত থেকে কোনো আয় ছিল না। তিন দিন ধরে তাঁর মুঠোফোনে বারবার ফোন করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী আবদুল কাদের জিলানী বলেন, ‘এমপি সাহেবের খুলনা অঞ্চলে চিংড়ির ঘের আছে বলে শুনেছি।’
জানতে চাইলে খুলনা জেলা মৎস্য কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, নূর-ই-আলম চৌধুরীর নামে জেলায় কোনো চিংড়িঘের নেই।
ঢাকা-১ আসনের সাংসদ সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান ‘পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত’ পাঁচটি মৎস্য খামারের উল্লেখ করেছেন হলফনামায়। তবে গত নির্বাচনের হলফনামায় এই সম্পত্তির কোনো উল্লেখ ছিল না।
দোহার উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৫ নভেম্বর মান্নান খান ও তাঁর স্ত্রী সৈয়দা হাসিনা মান্নানের নামে মৎস্য খামারের প্রত্যয়নপত্র নেওয়া হয়। উপজেলার মৎস্য কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, আবেদনে মান্নান খান সুনির্দিষ্ট কোনো মৌজা বা দাগ উল্লেখ করেননি। শুধু উল্লেখ করেছেন, দোহার-নবাবগঞ্জের আড়িয়ল বিলের বিভিন্ন স্থানে আধুনিক প্রযুক্তিতে মৎস্য উৎপাদন খামার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার কৈলাইল ইউনিয়নের কৈলাইল গ্রামে আট একর জমিতে মৎস্য চাষের খামার রয়েছে। তবে এসব এলাকায় গিয়ে মান্নান খানের নামে কোনো মৎস্য খামারের সন্ধান পাওয়া যায়নি। মান্নান খান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আড়িয়ল বিলে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তিতে মৎস্য খামার রয়েছে।
কুষ্টিয়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহবুব উল আলম হানিফ এবারের হলফনামায় মৎস্য খাত থেকে বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন তিন কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০০৮ সালে কুষ্টিয়া-২ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন তিনি। সে সময়ে দেওয়া হলফনামায় মৎস্য খাতে কোনো আয় ছিল না। খুলনার দাকোপ ও পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালিতে তাঁর মাছের খামার আছে বলে প্রথম আলোর কাছে তিনি দাবি করেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নব্বইয়ের দশকে এসব এলাকায় তাঁর মাছের খামার থাকলেও এখন আর নেই। হানিফ এ সরকারের প্রায় পুরো মেয়াদেই প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ছিলেন।
ঢাকা-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ মৎস্য প্রকল্প থেকে বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন পাঁচ কোটি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুর বেড়িবাঁধে মাইজাল মৎস্য প্রকল্পের চেয়ারম্যান ইলিয়াস মোল্লাহ। এ প্রকল্পে এখন ৪০ জনের অংশীদারি আছে। এখানে তাঁর এখন ছয়টি শেয়ার আছে।
যোগাযোগ করা হলে গত সোমবার ইলিয়াস মোল্লাহ বলেন, পুরো প্রকল্পটিই তাঁর। যাঁদের শেয়ার ছিল তাঁরা সবাই আট-নয় বছর আগে প্রকল্প থেকে সরে গেছেন। ২০০৮ সালে ইলিয়াস মোল্লাহ এই খাত থেকে আয় দেখিয়েছিলেন ৩০ লাখ টাকা। এবার হঠাৎ এত বেশি আয় কীভাবে হলো? তাঁর জবাব, সে সময় (২০০৮ সালে) ৩০ জনের শেয়ার ছিল।
ওই ৩০ ব্যক্তির মধ্যে দুজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে শেয়ারপ্রতি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা প্রতিবছর লাভ পাওয়া যায়। তাঁদের মতে, বার্ষিক পাঁচ কোটি টাকা লাভের হিসাব সঠিক নয়।
সৎভাবে আয় করার জন্য মৎস্য খাতে বিনিয়োগ করেছেন বলে দাবি চট্টগ্রাম-৬ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর। মৎস্য খাত থেকে অর্জিত দুই কোটি ৪৯ লাখ ৯৭ হাজার ৩০০ টাকার সম্পদ তিনি হলফনামায় দেখিয়েছেন। ২০০৮ সালে এই খাতে তাঁর কোনো আয় ছিল না। তিনি জানান, তাঁর প্রকল্পের নাম রাউজান মৎস্য খামার।
দিদারুল আলম চট্টগ্রাম-৪ থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। হলফনামায় মৎস্য খাতে দেখানো হয়েছে ছয় কোটি ৯৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। গত নির্বাচনে তিনি প্রার্থী ছিলেন না। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিদারুল আলমের বেশ কয়েকটি পারিবারিক পুকুর আছে। সেখানে মৎস্য চাষ হয় না। তবে তাঁর একাধিক মাছ ধরার ট্রলার আছে।
বাগেরহাট-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক মৎস্য চাষে সাড়ে তিন কোটি টাকার বেশি বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন। বারবার চেষ্টা করেও এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।