
চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং অক্টোবরে ঢাকায় এসে দুই দেশের সহযোগিতাকে অর্থনীতি থেকে রাজনৈতিক পর্যায়ে উত্তরণের স্পষ্ট বার্তা দিয়ে গেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে দুই দেশ। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সারা বছরের সময়সূচিভিত্তিক কাজের তালিকা তৈরি করছে বাংলাদেশ ও চীন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে জানান, চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের পর্যালোচনার জন্য ২৭ ডিসেম্বর সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক সমন্বয় সভা হবে। ওই আলোচনায় শি চিন পিং ঢাকা ঘুরে যাওয়ার আড়াই মাস পর কোথায় কী অগ্রগতি হয়েছে, তা নিয়ে পর্যালোচনা হবে। পাশাপাশি আগামী বছরের কর্মপরিকল্পনার খসড়া তৈরি হবে।
এদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্টের শীর্ষ বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো পর্যালোচনা হবে পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে। ২০১৭ সালের প্রথম তিন মাসের মধ্যে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকটি হতে যাচ্ছে।
১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সফরের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে বসেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং। দুই শীর্ষ নেতার আলোচনা শেষে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও চীন। ওই বৈঠকের পর প্রচারিত যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, ২০১৭ সাল হবে বাংলাদেশ ও চীনের ‘বন্ধুতার বছর’।
ঢাকায় চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূত চাই সি মনে করেন, শি চিন পিংয়ের সফরের মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের পথনির্দেশনা রয়েছে। বার্তা সংস্থা সিনহুয়াকে তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্তরের উচ্চপর্যায়ে পারস্পরিক আস্থা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে সম্পর্ককে নতুন ধাপে নেওয়ার এটাই সঠিক সময়।
১৪ ও ১৫ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের সময় নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট অন্য এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, ওই সফরে ১৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক এবং ১১টি ঋণসংক্রান্ত বাণিজ্য চুক্তি সব মিলিয়ে ২৭টি দলিল সই হয়েছে। ঋণসংক্রান্ত ১১টি বাণিজ্য চুক্তির বেশ কয়েকটি পুরোনো এবং কয়েকটি নতুন। এগুলো বাস্তবায়নের কাজ এর মধ্যেই শুরু হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন খাতে যে ১৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য দুই দেশের কর্মকর্তাদের নিয়ে যৌথ গ্রুপ গঠনের কাজ চলছে। যেমন উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যেই রূপরেখা চুক্তিটি হয়েছে, তা বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে হয়ে গেছে যৌথ গ্রুপ গঠনের কাজ।
এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা জানান, সামগ্রিকভাবে হাসিনা-চিন পিং শীর্ষ বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দুই দেশ আলাদা করে দুটি টাস্কফোর্স গঠন করছে। বাস্তবায়নের নানা পর্যায়ে এসে টাস্কফোর্স নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করবে।
যৌথ বিনিয়োগ ও পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুৎ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, নদীশাসন এবং বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোসহ বাংলাদেশের বেশ কিছু ক্ষেত্রে অন্তত ২২টি প্রকল্পে চীন সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এ নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভবিষ্যতের সহযোগিতার বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে এই প্রকল্পগুলো নিয়ে কথা হয়েছে। দুই দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রকল্পগুলো চূড়ান্ত করবে। তবে সবগুলো প্রকল্প একসঙ্গে নয়, ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
জানা গেছে, দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অক্টোবরের বৈঠকে পদ্মা সেতুতে চীনের অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সে অনুযায়ী পদ্মা সেতুতে রেললাইন স্থাপনের জন্য আর্থিক সহযোগিতা চেয়ে এর মধ্যেই চীনের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া নতুন ক্ষেত্র হিসেবে সামুদ্রিক অর্থনীতিতে কোথায় কোথায় সহযোগিতা চায়, সেটিও চীনকে জানিয়েছে বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মুন্সি ফয়েজ আহমেদ গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও চীন একে অন্যের স্বার্থে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রয়োজন। দুই দেশের মধ্যে একে অন্যের প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর ক্ষমতা বেড়েছে। চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সময় পৃথিবীর বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখার কথাটি বেশ উচ্চারিত হয়েছে। তবে সফর শেষে দেখা গেছে, সব দিক থেকে এটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হয়েছে। সচেতনভাবে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রাখার কথা বিবেচনা করলে এটা হতো কি না প্রশ্ন আছে। বন্ধু দেশগুলোকে বাংলাদেশের বোঝাতে হবে, দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে সহজ শর্তে যার কাছে যা পাওয়া যাবে সেটি নেবে বাংলাদেশ। কোনো একটি দেশ যদি বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী সহযোগিতা দিতে না পারে, সেটি অন্য দেশ থেকে নিতে হবে।’
জানা গেছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ-চীন বন্ধুতার বছরে যেসব কর্মসূচি থাকবে তাতে রাজনীতি থেকে শুরু করে নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ দমন, অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয় যুক্ত থাকবে। জুনের মাঝামাঝি চীনের একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে এই কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক সূচনা হবে।