অর্থমন্ত্রী বললেন, শিক্ষকদের আন্দোলন অযৌক্তিক
শিক্ষক আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অচল। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ও পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন শিক্ষকেরা।
সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচি চালুর প্রতিবাদে শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অচল হয়ে পড়ার পর অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, এই আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষও গতকাল মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যয় কর্মসূচি নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। প্রত্যয় কর্মসূচিতে শিক্ষকদের সুবিধা কমবে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা খণ্ডন করে এই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) দক্ষিণ, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ইয়াংমিং ইয়ং গতকাল বিকেলে অর্থমন্ত্রীর শেরেবাংলা নগরের কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকেরা অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনকে তিনি কীভাবে দেখছেন। জবাবে অর্থমন্ত্রী এক বাক্যে শুধু বলেন, এটা অযৌক্তিক (ইটস আনরিজনেবল)।
স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ ইত্যাদি ৪০৩টি সংস্থায় এখন থেকে যেসব কর্মী নতুন নিয়োগ পাবেন, তাঁদের জন্য ১ জুলাই থেকে প্রত্যয় কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ সব রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও সরকারি ব্যাংক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ বীমা করপোরেশনসহ সব করপোরেশন, পেট্রোবাংলা, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ইত্যাদি সংস্থার ক্ষেত্রে প্রত্যয় প্রযোজ্য।
বর্তমানে ৪০৩টি স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এদের মধ্যে ৯০টির মতো প্রতিষ্ঠানে পেনশন-ব্যবস্থা চালু আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ৬৫ বছর থেকেই আজীবন পেনশন পাবেন।
অন্য কোনো সংস্থা সর্বজনীন এই কর্মসূচির বিরুদ্ধে কথা না বললেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন সাড়ে তিন মাস ধরে। শিক্ষকদের আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান, পরীক্ষা ও সব ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে গত রাতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি আখতারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীর অযৌক্তিক বলাটা দুঃখজনক এবং আমরা অসন্তোষ জানিয়ে রাখলাম। যা বুঝতে পারছি ২০২৪ ও ২০৫৪ সালকে তাঁরা একাকার করে ফেলেছেন। এখনো আশা করব আমাদেরসহ বিশেষজ্ঞ দল নিয়ে তাঁরা বসবেন। তখন তাঁদের ভুলগুলো ঠিকই ধরা পড়বে।’
পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা
প্রত্যয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আপত্তির বিষয়ে এত দিন চুপচাপ থাকলেও জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গতকাল প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ‘প্রত্যয়ের কিছু বিষয়ে অধিকতর স্পষ্টীকরণ’ শীর্ষক এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সংস্থাটি বলেছে, পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনে ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন পাওয়ার কথা বলা আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যেহেতু ৬৫ বছর বয়সে অবসরে যান, তাই প্রত্যয় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর তাঁরা ৬৫ বছর থেকেই আজীবন পেনশন পাবেন। এ জন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করবে সরকার।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্যই সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি। তবে বর্তমানে সরকারি, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ সুগঠিত পেনশন-ব্যবস্থার আওতার বাইরে রয়েছেন। অর্থমন্ত্রী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে নতুন যোগদানকারী সরকারি কর্মচারীরাও সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আসবেন।
কর্তৃপক্ষ বলছে, সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে টেকসই পেনশন-ব্যবস্থার আওতায় আনতেই নতুন পেনশন কর্মসূচি। বর্তমানে ৪০৩টি স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের মধ্যে ৯০টির মতো প্রতিষ্ঠানে পেনশন-ব্যবস্থা চালু আছে। বাকি ৩১৩টি প্রতিষ্ঠানে চালু রয়েছে কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ)। সিপিএফ সুবিধার আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এককালীন আনুতোষিক পেয়ে থাকেন, তবে পেনশন পান না।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে সরকারিভাবে ‘আনফান্ডেড ডিফাইন্ড বেনিফিট’ পদ্ধতির পেনশন-ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। পেনশনের যাবতীয় ব্যয় বাজেট থেকে মেটানো হয়। এখন ‘ফান্ডেড ডিফাইন্ড বেনিফিট’ পদ্ধতির পেনশন-ব্যবস্থা চালু হওয়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বেতন থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে মাসিক জমার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর প্রাপ্ত মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম, তা কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বেতন হতে কর্তন করা হবে। যতটুকু কর্তন করা হবে, সেই পরিমাণ অর্থ দেবে প্রতিষ্ঠান। উভয় অর্থ সরকারি হিসাবে জমা হবে।
এতে আরও বলা হয়, আনফান্ডেড ডিফাইন্ড বেনিফিট পদ্ধতির পেনশন-ব্যবস্থায় সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ ক্রমাগত বাড়ছে। এটি দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই ব্যবস্থা নয়। অন্যদিকে ফান্ডেড কন্ট্রিবিউটরি পেনশন-ব্যবস্থায় কর্মীদের চাঁদা এবং বিনিয়োগের মুনাফার ভিত্তিতে একটি তহবিল গঠিত হবে। ফলে এটি দীর্ঘ মেয়াদে একটি টেকসই পেনশন-ব্যবস্থা। নতুন পেনশন-ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা-কাঠামোর মধ্যে আনা সম্ভব হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ২০০৪ সাল থেকে এ পেনশন-ব্যবস্থা চালু আছে।
২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত যেসব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিরত, তাঁরা আগের মতোই পেনশন-সুবিধা পাবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদনের পর নিজ বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পদে বা উচ্চতর কোনো পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তিনি সার্ভিস প্রটেকশন ও পে প্রটেকশন প্রাপ্ত হন বলে এটিকে নতুন নিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হয় না। সে ক্ষেত্রে তাঁদের বিদ্যমান পেনশন-সুবিধার আওতায় থাকার সুযোগ থাকবে। তাঁদের অর্জিত ছুটি প্রাপ্যতার ভিত্তিতে দেওয়া হয় বলে ছুটি জমা থাকা সাপেক্ষে তা–ও বহাল থাকবে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, কন্ট্রিবিউটরি পেনশন পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এককালীন নয়, বরং মাসিক পেনশনের যুক্তিসংগত পরিমাণ নির্ধারণ করাই অগ্রগণ্য। এ ক্ষেত্রে আনুতোষিকের ব্যবস্থা রাখা হয়নি; বরং বিদ্যমান মাসিক পেনশনের কয়েক গুণ বেশি মাসিক পেনশন দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রত্যয় কর্মসূচিতে মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতন থেকে কর্তন করা হলে এবং একই পরিমাণ অর্থ প্রতিষ্ঠান জমা করলে ৩০ বছর পর একজন পেনশনার প্রতি মাসে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা হারে আজীবন পেনশন পাবেন। তাঁর নিজ আয়ের মোট জমাকৃত অর্থের পরিমাণ হবে ১৮ লাখ টাকা এবং তিনি যদি ১৫ বছর ধরে পেনশন পান, সে ক্ষেত্রে তাঁর মোট প্রাপ্তি হবে ২ কোটি ২৪ লাখ ৩৮ হাজার ৮০০ টাকা। এ প্রাপ্তি তাঁর জমার প্রায় সাড়ে ১২ গুণ। পেনশনে যাওয়ার পর ৩০ বছর জীবিত থাকলে পেনশনার পাবেন তাঁর জমার প্রায় ২৫ গুণ অর্থ।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশনার আজীবন পেনশন পান। তাঁর অবর্তমানে পেনশনারের স্বামী বা স্ত্রী এবং প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেনশন পান। নতুন পেনশন-ব্যবস্থায়ও পেনশনার আজীবন পেনশন পাবেন। তবে পেনশনারের অবর্তমানে তাঁর স্বামী বা স্ত্রী অথবা নমিনি পেনশনারের পেনশন শুরুর তারিখ থেকে ১৫ বছরের যে সময় বাকি থাকবে, সে সময় পর্যন্ত পেনশন পাবেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন পেনশনার অবসরে যাওয়ার পর ৫ বছর পেনশন পেয়ে মারা গেলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর স্বামী বা স্ত্রী অথবা নমিনি আরও ১০ বছর পেনশন পাবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
তবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের এই ব্যাখ্যা সন্তুষ্ট করতে পারেনি শিক্ষকদের। প্রত্যয় কর্মসূচিকে ‘শুধু বৈষম্যমূলক নয়, অপরিপক্বও’ হিসেবে বর্ণনা করেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি আখতারুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি আরও বলেন, ‘কোনোরকম হিসাব ও দূরদর্শী পর্যবেক্ষণ ছাড়াই এটি চালু করা হয়েছে। প্রত্যয় কার্যকর হলে একজন অধ্যাপক বর্তমানে যে এককালীন প্রায় ৮১ লাখ টাকা আনুতোষিক পান, তা আর পাবেন না। আমরা চাই বেতনকাঠামোর মতো আলাদা পেনশন–কাঠামোও চালু করা হোক।’