অগ্নিনিরাপত্তা: বিচ্ছিন্ন অভিযান, তদন্ত গতিহীন
সমন্বয়হীন অভিযানে নেমেছিল পাঁচ সংস্থা। তাতে ভাটা পড়েছে। দুই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেয়নি। সিআইডির তদন্তে অগ্রগতি নেই।
রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর সরকারি সংস্থাগুলো ‘যে যার মতো’ শত শত রেস্তোরাঁ ও ভবনে অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীন এসব অভিযানের সুফল নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বেইলি রোডের ভবনটিতে আগুন লাগে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে। ৩ ও ৪ মার্চ শুরু হয় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে অভিযান। দুই সিটির সঙ্গে ছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর।
ডিএমপি এই ১০ দিনে ১ হাজার ১৩২টি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে। রাজউক ৩৩টি ভবনে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ৪৭ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দুটি ভবন ও দুটি রেস্তোরাঁ সিলগালা করার পাশাপাশি ৭টি প্রতিষ্ঠানকে ৭ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন জরিমানা করেছে ২২টি প্রতিষ্ঠানকে, পরিমাণ ৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা।
সরকারি সংস্থাগুলো ‘দায় সারতে’ই অভিযানগুলো চালাচ্ছে বলে মনে করেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দায়সারা অভিযানে সমস্যার সমাধান হবে না। এটা করতে হবে পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে। তিনি বলেন, অভিযানের আগে ভবনগুলো কী অবস্থায় আছে, সে বিষয়ে জরিপ করা প্রয়োজন। যেসব ভবনে নিরাপত্তা ঘাটতি রয়েছে, সেসব ভবন কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করার পাশাপাশি নিয়মিত সমন্বিত অভিযান চালাতে হবে।
‘দায় সারা’র অভিযানেও ইতিমধ্যে ভাটা পড়েছে। ডিএমপির অভিযান বন্ধ। দক্ষিণ সিটি গতকাল বুধবার কোনো অভিযান চালায়নি। উত্তর সিটি চালিয়েছে। রাজউক গতকাল তিনটি ভবনে গেছে।
■ পুলিশের অভিযানে ৩ মার্চ থেকে গ্রেপ্তার ৮৭২ জন।
■ ৩৩টি ভবনে রাজউকের অভিযানে সাড়ে ৪৭ লাখ টাকা জরিমানা।
■ দুটি ভবন ও দুটি রেস্তোরাঁ সিলগালা করেছে দুই সিটি করপোরেশন। জরিমানা করেছে ১৩ লাখ টাকা।
এদিকে বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় গঠিত ফায়ার সার্ভিস ও রাজউকের দুটি তদন্ত কমিটির একটিও প্রতিবেদন দেয়নি। ফায়ার সার্ভিসের কমিটিকে দ্রুততম সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। রাজউকের তদন্ত কমিটিকে সময় দেওয়া হয়েছিল সাত কার্যদিবস, যা শেষ হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির প্রধান ও সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের তদন্ত শেষ হয়নি।
দুই কমিটি প্রতিবেদন না দেওয়ায় জানা যায়নি যে ভবনটিতে সরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের কোনো দায় রয়েছে কি না। এদিকে আগুনের ঘটনায় রমনা থানায় হওয়া মামলার তদন্তেও বড় কোনো অগ্রগতি নেই। গ্রেপ্তার চার ব্যক্তি এখন কারাগারে রয়েছেন। মামলাটির তদন্ত থানা-পুলিশ থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর করা হয়েছে। সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা তদন্ত শুরু করেছেন। এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতির খবর নেই।
দায়সারা অভিযানে সমস্যার সমাধান হবে না। এটা করতে হবে পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে।
বেইলি রোডের ভবনটিতে আগুন লাগার পর বেরিয়ে এসেছিল যে সেই ভবনে রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদন ছিল না। ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির কথা জানত ফায়ার সার্ভিস। তারা তিন দফা চিঠিও দিয়েছিল।
বিষয়টি সামনে এলে ব্যাপক সমালোচনা হয়। তখন ৩ মার্চ রাত থেকে প্রথম অভিযানে নামে ডিএমপি। ৩ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত তিন দিনে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ডিএমপি ১ হাজার ৩৪৭টি অভিযান চালায়। এর মধ্যে রেস্তোরাঁ রয়েছে ১ হাজার ১৩২টি, গ্যাস সিলিন্ডারের দোকান ২০৭টি এবং রাসায়নিকের গুদাম ৮টি। এসব অভিযানে ৮৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে ডিএমপির এই অভিযান এখন আর চলমান নেই।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খন্দকার মহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, অভিযান তো আর সব সময় একভাবে চলবে না। যখন প্রয়োজন হবে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যাবে, তখন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, অন্য দায়িত্বশীল সংস্থার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা বা কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে পুলিশ সহায়তা করবে।
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাসুদ আর সোবহান ও ফাতেমা এস চৌধুরীর এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ঢাকার রেস্তোরাঁ থেকে গ্রেপ্তার শ্রমিক ও কর্মচারীদের নাম ও সংখ্যা দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল রুলসহ এ আদেশ দেন।
আইনজীবী মাসুদ আর সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের মহাপরিদর্শকে এক মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাজউক, সিটি করপোরেশন কী করছে
রাজধানীর নকশা অনুযায়ী নির্মিত হচ্ছে কি না; ভবনগুলোতে কী থাকার কথা, আর কী থাকছে, তা দেখার দায়িত্ব রাজউকের। তাদের সেই দায়িত্ব পালনে ব্যাপক ঘাটতির কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু বেইলি রোডে আগুনের পর রাজউক অভিযানে নেমে পড়েছে। ‘বিচ্ছিন্নভাবে’ বিভিন্ন ভবনে গিয়ে রাজউকের কর্মকর্তারা জরিমানা শুরু করেন।
রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ দাবি করেছেন, তাঁদের অভিযান নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজউক শুধু বেইলি রোডের আগুনের পর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে, বিষয়টি তেমন নয়। এ ধরনের অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করা হয়। ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (ব্যবহার সনদ) আছে কি না, অগ্নিনিরাপত্তাসহ সবকিছু নিয়ম মেনে হয়েছে কি না—এসব বিষয় দেখার জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে দুটি আন্ত সংস্থা দল গঠন করে দেওয়া হয়েছে। সেই দল সমন্বিতভাবে কাজ করে।
অবশ্য রাজউকের একটি সূত্র বলছে, বেইলি রোডে আগুন লাগার পর ৪ মার্চ সংস্থাটির নগর উন্নয়ন কমিটির সভা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে ঢাকায় রাজউকের ৮টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালকের নেতৃত্বে ৮টি আন্ত সংস্থা দল গঠন করা হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রতিনিধির নাম চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এই দলের অভিযান এখনো শুরু হয়নি। দল গঠনের কাজও শেষ হয়নি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সমন্বিত অভিযানের বিষয়ে ১৪ মার্চ (আজ বৃহস্পতিবার) একটি সভা ডেকেছে রাজউক। সেখানে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। তিনি বলেন, লোক দেখানোর কিছু নেই। এখন থেকে ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টিও শক্তভাবে তদারকির আওতায় আনা হবে।
রাজউকের সমন্বিত অভিযানের পরিকল্পনার মধ্যে গতকালও সংস্থাটির একটি দল ধানমন্ডির ৯/এ নম্বর সড়কে তিনটি ভবনে যায়। দুটি বাড়িতে জরিমানা করা হয়।
যেমন ধানমন্ডির একটি বাড়িতে গিয়ে রাজউকের দল দেখতে পায়, ভবনটি আবাসিক হিসেবে অনুমোদন নেওয়া। তবে সেখানে নিচতলা ও দোতলায় রেস্তোরাঁ করা হয়েছে। চতুর্থ তলায় রয়েছে একটি বেসরকারি স্কুল। রাজউকের এই অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মনির হোসেন হাওলাদার বলেন, আবাসিক ভবন থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অপসারণের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
নগর–পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, ঢাকায় হাজার হাজার ভবনে এমন অনুমোদনহীন স্থাপনা পাওয়া যাবে। অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিতে থাকা ভবন সংখ্যাও অসংখ্য। ফায়ার সার্ভিস বলছে, ঢাকায় ২ হাজার ৬০৩টি ভবন অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া চার বছরে (২০২০-২০২৩) নকশা অনুমোদনের জন্য ৬ হাজার ২৮৪টি ভবন কর্তৃপক্ষ অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত পরিকল্পনা ছাড়পত্র নিয়েছে। কিন্তু ভবন নির্মাণের পর অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ের পর সনদ নিয়েছে মাত্র ৪৮৪টি ভবন কর্তৃপক্ষ।
রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রণয়নের জন্য একটি জরিপ করা হয়েছিল। ওই জরিপে উঠে আসে, ড্যাপের আওতাধীন এলাকায় ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৯৫ হাজার নতুন স্থাপনা হয়েছে। তবে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে গড়ে ৪ হাজার ১৭৫টির। মানে হলো, নির্মিত স্থাপনার ৯৫ শতাংশই অবৈধ।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজউকসহ সরকারি সংস্থার গাফিলতিতে রাজধানীজুড়ে অবৈধ ভবন, অনুমোদনহীন রেস্তোরাঁ, ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতান, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি গড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে। এসব স্থাপনা হঠাৎ অভিযান চালিয়ে ভেঙে ফেলা বা বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়; বরং জরিপ করে, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা করে এবং সমন্বিতভাবে এগুলো নিরাপদ করতে কাজ করা দরকার। নইলে বারবার দুর্ঘটনা ঘটবে এবং তারপর সরকারি সংস্থাগুলো ‘লোকদেখানো’ অভিযানে নেমে পড়বে।
কেউ কেউ বলছেন, এ ধরনের অভিযান আতঙ্ক তৈরি করে। তা সরকারি সংস্থাগুলোর অসাধু কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার সুযোগও তৈরি করে দেয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল–পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার বিচ্ছিন্ন অভিযান দীর্ঘ মেয়াদে ফলপ্রসূ কিছু হবে না। পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদামগুলোতে অভিযানের সময় দেখা গেছে, শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ছিল। এখানেও একই কথা প্রযোজ্য।