জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ
নতুন আবেদন, সংশোধনে ‘সার্ভার ডাউন’ ভোগান্তি। ত্যক্তবিরক্ত লোকজন।
ফাতেমা আক্তার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। চলতি বছর থেকে জেএসসি পরীক্ষা ব্যবস্থা তুলে দিয়েছে সরকার। তবে বার্ষিক পরীক্ষার ফল বোর্ডে পাঠানোর প্রয়োজনে স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের নিবন্ধন করা হচ্ছে। ফাতেমা এই নিবন্ধন ফরম পূরণ করতে পারছে না জন্মনিবন্ধনে তার ও মায়ের নামের বানান ভুল থাকায়। বাবা মারা গেছেন। তিন মাস ধরে সংশোধনীর জন্য একা ছোটাছুটি করছেন মা মেহেরুন নেছা।
২ অক্টোবর মিরপুর ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে কথা হয় মেহেরুন নেছার সঙ্গে। সংশোধনীর জন্য আবেদনের কাগজ নিয়ে এসেছিলেন। ভোগান্তির কথা বলতে গিয়ে চোখ পানিতে ভরে উঠেছিল এই নারীর। তিনি জানালেন, কর্তৃপক্ষ তাঁদের দুজনের ইংরেজি সনদ নিজেরা বাংলায় করতে গিয়ে ইচ্ছেমতো নাম লিখেছে। এখন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাঁদের। তিনি জানান, সংশোধনীর জন্য আবেদনই করতে পারছিলেন না শুরুতে। কখনো শুনেছেন ‘সার্ভার বন্ধ’, কখনো শুনেছেন ‘সার্ভার ডাউন’। ৩ অক্টোবর মেয়ের স্কুলের নিবন্ধন ফরম জমা দেওয়ার শেষ দিন। এখন ভুলে ভরা জন্মসনদ জমা দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
ওই কার্যালয়ে ফারহানা ফেরদৌস নামের আরেক নারী বললেন, এক মাস চেষ্টা করার পর ১ অক্টোবর সন্ধ্যায় একটি দোকান থেকে তাঁর মেয়ের জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পেরেছেন। দোকানের কর্মী শুধু বলতেন, ‘সার্ভার ডাউন’।
একটি সার্ভার স্থাপন করার সময় একই সঙ্গে কত লোক তা ব্যবহার করতে পারে, সেটি মাথায় রেখে সার্ভারের কার্যক্ষমতা নির্ধারণ করা উচিত। সার্ভারটি কেন যথাযথভাবে কাজ করছে না, সেই কারণগুলো খুঁজে বের করা দরকার।অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন, পরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট
ন্যাশনাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র অক্ষয় রাম দত্ত জানান, তাঁর জন্মসনদে ‘রাম’ শব্দটি বাদ পড়েছে। সংশোধনের জন্য আবেদনই করতে পারছেন না। নিজে চেষ্টা করেছেন, দোকানেও গেছেন। দোকানের কর্মী বলছেন, ‘সার্ভারে সমস্যা’। এই অবস্থায় তিনি কী করবেন, জানতে কাউন্সিলরের কার্যালয়ে এসেছেন। উপস্থিত কেউ কেউ তাঁকে সন্ধ্যার পর বা মধ্যরাতে আবেদন করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘তখন সার্ভার পেতে পারেন।’
এমন নাগরিক ভোগান্তির মধ্যে আজ ৬ অক্টোবর পালিত হচ্ছে জাতীয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করি, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করি।’
কখনো শুনেছেন ‘সার্ভার বন্ধ’, কখনো শুনেছেন ‘সার্ভার ডাউন’। ৩ অক্টোবর মেয়ের স্কুলের নিবন্ধন ফরম জমা দেওয়ার শেষ দিন। এখন ভুলে ভরা জন্মসনদ জমা দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
বড় সমস্যা এখন ‘সার্ভার ডাউন’
জন্ম ও মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করলে কোনো ফি লাগে না। ৪৫ দিন থেকে ৫ বছরের মধ্যে করলে ২৫ টাকা, ৫ বছর পর করলে ৫০ টাকা, জন্মতারিখ সংশোধনের জন্য ১০০ টাকা এবং জন্মতারিখ ছাড়া সনদে অন্য তথ্য সংশোধনের জন্য ৫০ টাকা ফি লাগে।
এত দিন জন্মনিবন্ধন নিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, ৫০ টাকার স্থলে দেড়–দু্ই হাজার টাকা অর্থাৎ ৩০–৪০ গুণ বেশি খরচ করতে হয়। তবে গত দুই মাস ধরে আবেদন করতে গিয়ে এত বেশি সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে নাগরিকদের যে তাঁরা বাড়তি খরচের ‘শোক’ ভুলতে বসেছেন। বিশেষ করে নতুন বছরে স্কুল ভর্তির কারণে অক্টোবর মাস থেকে অনেক মা–বাবা সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে চাইছেন। মা-বাবার জন্মসনদ লাগার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়েছিল মাঝে। সেটা আবার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এক শিশুর অভিভাবক জানান, তিনি এক মাস ধরে চেষ্টা করেও আবেদন করতে পারেননি। সকাল–সন্ধ্যা–রাত—সব বেলাতেই চেষ্টা করে দেখেছেন, নির্দিষ্ট সাইটে কাজ করতে পারেননি।
বিশেষ করে নতুন বছরে স্কুল ভর্তির কারণে অক্টোবর মাস থেকে অনেক মা–বাবা সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে চাইছেন। মা-বাবার জন্মসনদ লাগার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়েছিল মাঝে। সেটা আবার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এক অভিভাবক জানান, তাঁর সন্তানের পাসপোর্টের জন্য জন্মসনদ পাওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। তিনি সাত হাজার টাকা খরচ করে সনদ নিয়েছেন।
তবে শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা সুমি আক্তারের মতে, তাঁর ‘ভাগ্য’ ভালো। স্কুলে ভর্তির জন্য তাঁর সন্তান সাফওয়ানা রহমানের জন্মনিবন্ধনের আবেদন দুই দিনের চেষ্টাতেই করতে পারেন।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ অনলাইনে হচ্ছে। দিনে গড়ে ২০ হাজার জন্মনিবন্ধন হয়। মৃত্যুনিবন্ধন অনেক কম হয়। নতুন বছরে স্কুলে ভর্তির জন্য এখন থেকে নতুন জন্মনিবন্ধনের চাপ শুরু হবে। দিনে গড়ে ৩০ হাজারের বেশি আবেদন হতে পারে।
ধারণক্ষমতার চেয়ে আবেদন বেশি হওয়ায় সার্ভারে দ্রুতগতিতে যথাযথভাবে কাজ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত জুলাই মাসে নিবন্ধন নেওয়া লাখ লাখ ব্যক্তির তথ্য ফাঁস হওয়ার ঘটনা প্রকাশ পেলে অনলাইনে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের জন্য ব্যক্তির নিজে আবেদন করার সুযোগ আগস্ট মাসজুড়ে বন্ধ থাকে। পরে সার্ভারের ত্রুটি সারানোর পর বেশির ভাগ সময় সার্ভারটিতে কাজ করা যায় না।
তাঁরা ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে নিবন্ধনের কাজ শুরু করতে পেরেছেন। দিনে ছয়-সাতটি নতুন আবেদন জমা পড়ে। ‘সার্ভার ডাউন’ থাকায় কাজে ধীরগতি থাকে।
সেপ্টেম্বর মাস থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে পুরোনো ওয়ার্ডগুলোতে (১ থেকে ৩৬ নম্বর) জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে স্থানান্তর হয়। নতুন ওয়ার্ড (৩৭ থেকে ৫৪ নম্বর) কাউন্সিলর কার্যালয়ে সচিবের পদ শূন্য থাকায় সেখানে নিবন্ধনের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। তবে গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে নিবন্ধনকাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কেউই সময়মতো শুরু করতে পারেনি। তাঁদের ভাষ্য ছিল, সার্ভার ডাউন।
মিরপুর ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিব মো. আবুল হাশেম বলেন, তাঁরা ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে নিবন্ধনের কাজ শুরু করতে পেরেছেন। দিনে ছয়-সাতটি নতুন আবেদন জমা পড়ে। ‘সার্ভার ডাউন’ থাকায় কাজে ধীরগতি থাকে। অনলাইনে আবেদন চেক করে প্রিন্ট দিতে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
ডিএনসিসির ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ৭ দিন ধরে তাঁরা নিবন্ধনের কাজ করতে পারছেন। এ পর্যন্ত ৬৪টি আবেদন পেয়েছেন। সার্ভারে কাজ করার মতো দক্ষ লোকজনের অভাব রয়েছে। রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে সমস্যা এতটা প্রকট থাকত না।
এদিকে রাজস্বের অর্থ নিয়ে দ্বন্দ্বে তিন মাস ধরে বন্ধ থাকার পর ৪ অক্টোবর থেকে স্বতন্ত্র সার্ভারের মাধ্যমে আঞ্চলিক কার্যালয়ে নিবন্ধনকাজ শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ডিএসসিসির কর্মকর্তাদের দাবি, তাঁদের নিজস্ব সার্ভারটি উচ্চ ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন। ফলে দক্ষিণের বাসিন্দাদের ‘সার্ভার ডাউন’ সমস্যায় ভুগতে হবে না।
অনেকে ঠিকভাবে আবেদন করতে পারেন না। আবার দক্ষ লোকের অভাবে স্থানীয় কার্যালয়গুলোও ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। তাঁরা সার্ভারের ওপর দোষ চাপিয়ে লোকজনকে ফিরিয়ে দেন। সার্ভারে কোনো ধরনের সমস্যা নেই।
ঢাকার বাইরেও সমস্যা প্রকট
ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের নতুন আবেদন ও সংশোধন করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা থেকে রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বোনের জন্মসনদে নামের সংশোধনের জন্য দুই মাস ধরে চেষ্টা করছেন। শুরুতে আবেদন করতেই পারছিলেন না। ৩ অক্টোবর তিনি নিবন্ধন সাইটে ঢুকতে পারেন। তবে সব তথ্য দিয়ে মুঠোফোন নম্বর দিয়ে ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) পাঠানো অপশনে গিয়ে ক্লিক করলেও ওটিপি পাননি। পরদিন আবেদন সাবমিট করতে পারেন, কিন্তু অনলাইনে ফি দিতে পারছিলেন না। পরে ইউএনও কার্যালয়ে গিয়ে সমস্যার কথা জানালে তাঁরা বলেন, সার্ভার ডাউন। গতকাল রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে ফোন করে সমস্যার কথা জানালে তাঁকে বলা হয়, সার্ভারে কাজ চলছে। এ জন্য একটু সমস্যা হচ্ছে।
‘সার্ভারে কোনো সমস্যা নেই’
তবে সার্ভারে সমস্যা থাকার কথা স্বীকার করেননি রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, অনেকে ঠিকভাবে আবেদন করতে পারেন না। আবার দক্ষ লোকের অভাবে স্থানীয় কার্যালয়গুলোও ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। তাঁরা সার্ভারের ওপর দোষ চাপিয়ে লোকজনকে ফিরিয়ে দেন। সার্ভারে কোনো ধরনের সমস্যা নেই।
সার্ভারের ধারণক্ষমতা বাড়ানো হবে কি না, জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, ঠিকভাবে কাজ করার জন্য সার্ভারে যা যা করা প্রয়োজন, সবকিছুই করা হয়েছে।
‘সার্ভারটিকে ব্যবহারবান্ধব করতে হবে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একটি সার্ভার স্থাপন করার সময় একই সঙ্গে কত লোক তা ব্যবহার করতে পারে, সেটি মাথায় রেখে সার্ভারের কার্যক্ষমতা নির্ধারণ করা উচিত। সার্ভারটি কেন যথাযথভাবে কাজ করছে না, সেই কারণগুলো খুঁজে বের করা দরকার। সার্ভারের ধারণক্ষমতা কম থাকলে তা বাড়াতে হবে, সার্ভারের কোডে কোনো বাগ বা ত্রুটি থাকলে দ্রুত সেটি খুঁজে বের করে ঠিক করতে হবে এবং সার্ভারটিকে ব্যবহারবান্ধব করতে হবে। সাধারণ লোকজন যদি তা ব্যবহার করতে না পারেন, তবে সে ব্যর্থতা সেবা প্রদান করার জন্য তৈরি সিস্টেমের। এখানে উচিত হবে কোন ধাপে কী করতে হবে ব্যবহারকারীর জন্য, সেই নির্দেশিকা সেই ধাপে ব্যবহারবান্ধবভাবে দেখানোর ব্যবস্থা করা। যে কারণেই হোক না কেন, সার্ভার ঠিকভাবে কাজ না করায় যথাযথ সেবা না পেয়ে লোকজন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।