২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

সার আমদানিতে ডলার সংকটসহ ৩ সমস্যা, সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা

কৃষি মন্ত্রণালয় আমদানিকারকদের পাওনা টাকা দিতে পারছে না। ব্যাংকে ডলার-সংকটে আমদানি কঠিন হয়েছে।

মার্কিন ডলারের সংকট, সরবরাহকারীদের পাওনা ও দরপত্রে অংশ নিতে ঠিকাদারদের অনীহা—নতুন অর্থবছরের (২০২৩-২৪) শুরুতে সার আমদানি করতে গিয়ে এই তিন সমস্যায় পড়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ফলে সারের সরবরাহ নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় ও সার আমদানিকারক সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের কাছে সরবরাহকারীদের পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। পাশাপাশি সার আমদানি করতে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা দরকার। সেটারও সংকট চলছে ব্যাংক খাতে।

অবশ্য সমস্যা শুধু সার আমদানিতে নয়, জ্বালানি আমদানিতেও প্রয়োজনীয় মার্কিন ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বেসরকারি খাতও পণ্য আমদানি করতে গিয়ে সংকটে পড়ছে। ওদিকে রাজস্ব আদায় যথেষ্ট পরিমাণে না হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ, সারসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকির টাকা যথাসময় দিতে পারছে না।

সার আমদানি ও সহজলভ্য করা সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তবে তাই বলে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি দামে সার আমদানি করা ঠিক হবে না।
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

দেশের কৃষি খাতে চাষাবাদ ও ফসলের উৎপাদন ঠিক রাখতে সারের নির্বিঘ্ন সরবরাহ জরুরি। কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে রাখতে সরকার ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করে। চলতি আমন ও আগামী জানুয়ারিতে শুরু হতে যাওয়া বোরো মৌসুমে সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকবে।

কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলার-সংকটজনিত সমস্যা আছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার-সংকট মোকাবিলা করার জন্য আমরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কথা বলছি।’

বকেয়া পাওনা পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করা হবে উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কাছে এখন পর্যাপ্ত সার মজুত আছে। সামনের বোরোর আগে আমরা এসব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারব।’

আমদানিতে অনীহা

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ৬০ লাখ টন সারের চাহিদা আছে। এর বড় অংশ আমদানি হয়, বাকিটা দেশের কারখানায় উৎপাদিত হয়। উৎপাদন আবার নির্ভর করে গ্যাস সরবরাহের ওপর।

২০২১-২২ অর্থবছরে সার বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫৯ লাখ টন। এর ৮৮ শতাংশ বা ৫২ লাখ টন আমদানি হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারের চাহিদা ধরা হয়েছে ৬৮ লাখ টনের কিছু বেশি। এর প্রায় ৪০ লাখ টন আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি দরপত্রে অংশ নিয়ে আমদানিকারকেরা বিশ্ববাজার থেকে সার আমদানি করেন। তবে বিক্রি করতে হয় সরকার নির্ধারিত দামে। বাড়তি খরচ ভর্তুকি হিসাবে দেয় সরকার।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শুরুতে ছয় লাখ টন সার আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের বড় আমদানিকারকেরা তাতে সাড়া দিচ্ছেন না। গত জুনে দুটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর একটিতে কেউ অংশ নেয়নি। দ্বিতীয়টিতে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। প্রতিষ্ঠানটির নাম সাইফুল্লাহ গালফ লিমিটেড। সেখানে প্রতি টন ডিএপি সারের দাম পড়েছে ৫১৫ মার্কিন ডলার ও টিএসপি ৪৮৫ ডলার।

বিশ্ববাজারে সারের দাম ব্যাপকভাবে কমেছে। বিশ্বব্যাংকের পণ্যের মূল্যতালিকা অনুযায়ী, গত বছর এপ্রিল-জুন সময়ে ইউরোপে সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউরিয়া সারের টনপ্রতি গড় দর ছিল ৭৭৪ ডলার, যা গত জুনে ২৮৮ ডলারে নামে।

সাইফুল্লাহ গালফ আরেকটি দরপত্রে ৩০ হাজার টন এমওপি সার আমদানির জন্য টনপ্রতি ৬০০ ডলার দরপ্রস্তাব করেছিল। বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি বিবেচিত হওয়ায় ওই প্রস্তাব বাতিল করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি।

সাইফুল্লাহ গালফের মালিক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিগত দুই বছরের সার আমদানির মূল্যবাবদ আমরা সরকারের কাছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা পাই। তারপরও এ বছর ঝুঁকি নিয়ে সার আমদানিতে রাজি হয়েছি।’ তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে গত সাত-আট মাস সারের দাম কম ছিল, এটা সত্য। তবে এখন বাড়তির দিকে।

বিশ্ববাজারে দাম কমেছে

বিশ্ববাজারে সারের দাম ব্যাপকভাবে কমেছে। বিশ্বব্যাংকের পণ্যের মূল্যতালিকা অনুযায়ী, গত বছর এপ্রিল-জুন সময়ে ইউরোপে সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউরিয়া সারের টনপ্রতি গড় দর ছিল ৭৭৪ ডলার, যা গত জুনে ২৮৮ ডলারে নামে। একই সময়ে ডিএপি সারের দাম টনপ্রতি ৮৬০ ডলার থেকে কমে ৪৫৫ ডলারে নেমেছে। আর টিএসপি সারের দাম টনপ্রতি ৮০৫ ডলার থেকে কমে হয়েছে ৩৯০ ডলার।

বিশ্ববাজারে সারের দাম কমলেও দেশে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। গত বছর মে মাসে যে ডলার ৮৬ টাকা ছিল, তা এখন ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা।

বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষি মন্ত্রণালয় গত এপ্রিলে সারের দাম কেজিপ্রতি ৫ টাকা করে বাড়ায়। এখন কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ২৭ টাকা, ডিএপি ২১ টাকা, টিএসপি ২৭ টাকা ও এমওপি ২০ টাকা। গত বছর সারে ভর্তুকি বাবদ সরকারকে ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। এ বছর বিশ্ববাজারে সারের দাম কমায় আশা করা হয়েছিল ভর্তুকি বাবদ ব্যয় কমবে। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক দামে আমদানি করতে না পারলে বেশি খরচ পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।

আরও পড়ুন

দেশের তিনটি বড় সার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে দ্রুত ঋণপত্র খোলা ও ডলার সরবরাহের ব্যবস্থা করলে আরও কম দামে সার সরবরাহ করা সম্ভব। কিন্তু পাওনা টাকা না দেওয়ায় আমদানিকারকেরা আমদানিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। ওদিকে সরকার একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আমদানি করাচ্ছে। এতে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হচ্ছে না। দাম বেশি পড়ছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, সার আমদানি ও সহজলভ্য করা সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তবে তাই বলে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি দামে সার আমদানি করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, ডলারের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করে ও আমদানিকারকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করে দ্রুত প্রতিযোগিতামূলক দামে সার আমদানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

আমনে চাহিদা বাড়তে পারে

দুটি কারণে এবার আমনে সারের চাহিদা বেশি হতে পারে—১. গত জুলাই মাসে বৃষ্টি কম হয়েছে। এতে মাটির উর্বরতা কমার আশঙ্কা আছে। ফলে বেশি সার দেওয়া লাগতে পারে। ২. বাজারে চালের দাম ভালো থাকায় কৃষকেরা বাড়তি জমিতে আমন আবাদ করতে পারেন, যা সারের চাহিদা বাড়াবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, এখনকার বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে ফসল চাষের সার আমদানি নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণে নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি কেনায় বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। বেতনও বাড়িয়েছে। কিন্তু সারের বকেয়া টাকা পরিশোধ করছে না। গত রমজানে পণ্য আমদানিতেও প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যায়নি।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি কর্মকর্তাদের তুষ্ট করার চেয়ে কৃষকের জন্য দ্রুত সার আনা বেশি জরুরি।

আরও পড়ুন