মাকে আর দেখা হলো না সাইমনের

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ১৮ জুলাই গুলিতে নিহত হন সাইমনছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে নিহত ১৪ বছরের সাইমনের লাশ চার দিন আগে গত রোববার সন্ধ্যায় দাফন হয়েছে সন্দ্বীপে তার নিজ বাড়িতে। তবে এখনো থামেনি মা রহিমা বেগমের বুকফাটা আর্তনাদ। সন্দ্বীপের হারামিয়া ইউনিয়নের শিকদার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মূল বাড়ির পাশে পুকুর ঘেঁষে সাইমনদের জরাজীর্ণ ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে রহিমার বিলাপের শব্দ। অতিদরিদ্র রহিমার পুরোনো টিনের চাল থেকে পানি পড়া রোধ করতে ঢেকে রাখা হয়েছে ত্রিপল দিয়ে। সেটা দেখিয়ে রহিমা বেগম বলেন, আর এই ত্রিপল কিনতে সাইমন পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছিল মাস দেড়েক আগে।

রহিমা বেগমের ঘরে আসবাব বলতে আছে কাঠের একটি ভাঙা চৌকি। নিচ থেকে ঠেস দিয়ে সেটিকে কোনোমতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। সাইমনের মা রহিমা বেগম ও খালা নাইমার সঙ্গে কথা হচ্ছিল বাড়ির অন্য একটি ঘরে বসে। সেখানেই আত্মীয় আর প্রতিবেশীরা একে একে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসছেন। সাইমনের কথা জানতে চাইলে রহিমা বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ছেলে আমারে দেখতে আইবো কইছিল বোনের বাসায় কিন্তু আর আইলো না। মারে আর দেখা হইল না সাইমনের।’

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট থেকে ১৮ জুলাই দুপুরে নিখোঁজ হয় সাইমন। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। টানা তিন দিন খালা নাইমা বেগম বহদ্দারহাট আর মুরাদপুরের বিভিন্ন জায়গায় হন্যে হয়ে খুঁজেছেন সাইমনকে। নাইমা জানান, তিন দিন খোঁজ করার পর ২০ জুলাই শনিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সাইমনের লাশ শনাক্ত করেন নাইমা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সাইমন বন্দর এলাকার ফকিরহাটে আমার বাসায় এসে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। বেলা একটায় আসার কথা, সেই ছেলে রাত আটটায়ও যখন আসেনি, তখন আমি আর আমার স্বামী তার খোঁজে বহদ্দারহাটে যাই। পুরো এলাকা তখন রণক্ষেত্র। সেখানে তাকে পাইনি। পরদিন শুক্রবারও তার খোঁজে সম্ভাব্য সবখানে গিয়েছি। শনিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তার লাশ পাই।’

এক প্রশ্নের জবাবে নাইমা বলেন, ‘আমার বোনের ছেলে শিশু বয়স থেকে মানুষের দোকানে কাজ করেছে। মা ও ভাইয়ের মুখে ভাত তুলে দিয়েছে। এই ছেলে রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করেনি কোনো দিন। দেড় বছর ধরে সে বহদ্দারহাটের একটি মুদিদোকানে কাজ করছিল। দোকানমালিকের বাসায় ভাড়া থাকি আমরা। মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে সে আমার বাসার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। পথেই মারা গেল।’

বাড়ির সামনে সাইমনের মা
ছবি: প্রথম আলো

দুই ছেলে তুশিন, সাইমন আর স্ত্রী রহিমাকে রেখে ২০১২ সালে মারা যান সাইমনের বাবা আমিন রসুল। রহিমা জানান, বাবার মৃত্যুর সময় সাইমনের বয়স ছিল দুই বছর। ছেলে দুটির মধ্যে সাইমন ছোট। বড় ছেলে তুশিন জন্মের পর থেকেই কিছুটা সাদাসিধে স্বভাবের। সাইমন পরিবারের রুটিরুজির জন্যই চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে মুদিদোকানে কাজ নিয়েছিল। রহিমা বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, ছেলে সাইমনই ছিল তার বেঁচে থাকার ভরসা। মাকে দেখতে আসতে চেয়েছিল সে। পথেই মারা গেল। রহিমা বলেন, ‘জীবন আর কিল্লাই (কিসের জন্য) রাইখতাম, কী উদ্দিশ্যে বাঁইচতাম, জানি না।’

ছেলে এবারের কোরবানির ঈদে বাড়িতে আসতে পারেনি। এতে রহিমার মন ভীষণ উতলা হয়ে ওঠে। ছেলেকে দেখার জন্য তিনি ব্যাকুল ছিলেন। রহিমা বলেন, ছেলেকে এক নজর দেখে আসার জন্য তাঁর মন ছটফট করছিল। কিছুদিন আগে তিনি ছেলের সঙ্গে পিঠাপুলি নিয়ে দেখা করতে যান। ওঠেন বোনের বাসায়। সেখানেই সাইমন দেখা করতে আসে। বৃহস্পতিবার আবার আসার কথা ছিল। কিন্তু সে লাশ হয়ে পড়ে রইল।