আওয়ামী লীগ আমলে বড় কর্তাদের জন্য ১৫ কোটি টাকায় তিনটি বিলাসী গাড়ি

গাড়ি ব্যবহার করছে বিজিএফসিএল। পড়ে আছে বাপেক্সের গাড়ি। তিতাসের গাড়ি কেনার আগেই সরকারের পতন হয়। 

প্রতীকী ছবি

প্রয়োজন ছিল না, তবু নিয়মের বাইরে গিয়ে জ্বালানি বিভাগের অধীনে থাকা তিনটি কোম্পানি বিলাসী গাড়ির অনুমোদন দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কয়েক মাস আগে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বোর্ড সভায় তা অনুমোদন হয়। পাঁচ কোটি টাকা করে তিনটি গাড়ির দাম ধরা হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। যদিও সরকারি পর্যায়ে গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে এই তিন গাড়ির দাম সাড়ে চার কোটি টাকার কম হওয়ার কথা।

বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) ও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির বোর্ড আলাদা করে এ অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে গ্যাস উৎপাদনকারী কোম্পানি বিজিএফসিএল ও বাপেক্স গাড়ি কিনেছে। আর বিতরণ কোম্পানি তিতাসের গাড়ি কেনার আগেই ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। 

জ্বালানি বিভাগের অধীনে থাকা কোম্পানিগুলোর চলমান প্রকল্পের অগ্রগতি দেখতে বছরে এক বা দুবার পরিদর্শনে যান মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। ওই সময় তাঁদের গাড়ি সরবরাহ করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। যদিও ব্যয় সংকোচন নীতির আড়ালে তাঁদের আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য নতুন এসব গাড়ি কেনার মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিল জ্বালানি বিভাগ।

এর মধ্যেই বড় কর্তাদের বিলাসিতার জন্য বড় গাড়ি (এসইউভি) কেনার অনুমোদন দেয় জ্বালানি খাতের তিন কোম্পানির বোর্ড। ওই তিন কোম্পানির বোর্ড চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তৎকালীন সচিব মো. নূরুল আলম।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার শেষের দিকে কৃচ্ছ্র সাধনের নীতি নিয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কড়া নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল। টাকা ও ডলারের সংকটে চাহিদামতো জ্বালানিও সরবরাহ করা যাচ্ছিল না। গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দামও নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। এর মধ্যেই বড় কর্তাদের বিলাসিতার জন্য বড় জিপ গাড়ি (এসইউভি) কেনার অনুমোদন দেয় জ্বালানি খাতের তিন কোম্পানির বোর্ড। ওই তিন কোম্পানির বোর্ড চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তৎকালীন সচিব মো. নূরুল আলম। তাঁর নির্দেশনায় গাড়ি তিনটি কেনার প্রক্রিয়া নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পর তাঁকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, সব কোম্পানিতে পাজেরো জিপ দেওয়া হতো চেয়ারম্যানকে। তবে গ্রেড-১ কর্মকর্তা হিসেবে তাঁকে আরও উন্নতমানের গাড়ি সরবরাহের নির্দেশনা দেন সাবেক জ্বালানিসচিব। এ বিষয়ে তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদেরও নির্দেশনা থাকতে পারে বলে মনে করেন কেউ কেউ। তিনি আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। 

গত বছরের ১ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য জিপ (অনূর্ধ্ব ২৭০০ সিসি) কেনা যাবে ট্যাক্স-ভ্যাটসহ ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকায়। সরকারি পর্যায়ে গাড়ি কেনার জন্য এ প্রজ্ঞাপন এখন পর্যন্ত কার্যকর আছে। এর চেয়ে বেশি দামে কোনো গাড়ি কেনার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 

গত সপ্তাহে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তিতাসের গাড়ি কেনার প্রস্তাবটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য তাঁর কাছে এসেছিল গত সরকারের আমলে। তিনি এটি নাকচ করে দিয়েছেন। আর বিজিএফসিএল ও বাপেক্সের গাড়ি কেনার প্রস্তাব তাঁর কাছে আসেনি। 

সূত্র বলছে, প্রকল্পের টাকায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি দামে গাড়ি কেনে কেউ কেউ। তবে তিনটি কোম্পানি গাড়ি কেনার বাজেট অনুমোদন নিয়েছে কোম্পানির রাজস্ব বাজেটের যানবাহন ক্রয় খাত থেকে। 

এ বিষয়ে তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদেরও নির্দেশনা থাকতে পারে বলে মনে করেন কেউ কেউ। তিনি আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। 

দ্রুত গাড়ি কেনে বিজিএফসিএল 

গাড়ি কেনার প্রস্তাব অনুমোদনের এক মাসের মাথায় গাড়ি কেনে বিজিএফসিএল। সূত্র বলছে, একটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো (টিএক্সএল) কিনতে গত ১০ ফেব্রুয়ারির বোর্ড সভায় অনুমোদন হয়। সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড থেকে গাড়িটি কেনা হয়। যদিও নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড গাড়ি তৈরি করে না। একটি বেসরকারি কোম্পানি থেকে গাড়িটি সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। গত ১০ মার্চ গাড়িটি সরবরাহ নেয় বিজিএফসিএল। ২৭০০ সিসির এ গাড়ি কেনা হয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা দামে।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন মো. ফজলুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই বোর্ডে অনুমোদন নিয়ে কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে বরাদ্দের চেয়ে অনেক কম দামে কেনা হয়েছে। তৎকালীন বোর্ড চেয়ারম্যান এটি তাঁর প্রয়োজনে ব্যবহার করতেন। সরকার পরিবর্তনের পর এটি বর্তমান চেয়ারম্যান দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করছেন। 

তিতাসে গাড়ি কেনার আগেই সরকার পতন

তিতাস সূত্র বলছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত তিতাসের বোর্ড সভায় ২৭০০ থেকে ৩২০০ সিসির একটি জিপ গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট থেকে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়। স্থানীয় দরপত্রপ্রক্রিয়ায় এটি কেনার কথা বলা হয় বোর্ডের সভায়। এরপর দরপত্র ডাকা হলেও সেটি চূড়ান্ত হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে তিতাস। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ শহর এলাকায় গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করে এ বিতরণ কোম্পানি। শহর এলাকার বাইরে তাদের কোনো প্রকল্প নেওয়ারও সুযোগ নেই।

বাপেক্স সূত্র বলছে, সোয়া চার কোটি টাকায় গাড়িটি কেনা হয় উন্মুক্ত দরপত্রপ্রক্রিয়ায়, কাজ পায় একটি বেসরকারি কোম্পানি। গাড়িটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসের আগেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর বেশ কিছুদিন গাড়িটি বন্দরে পড়ে ছিল। গাড়ি নিয়ে করণীয় ঠিক করতে সময় নেয় বাপেক্স।

গাড়ি নিয়ে বিপাকে বাপেক্স

গত ২৮ জানুয়ারি ২৭৫৫ সিসির একটি জিপ গাড়ি কেনার অনুমোদন হয় বাপেক্সের বোর্ড সভায়। এটি উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে কেনার কথা বলা হয় সভায়। প্রাক্কলিত দর অনুসারে ৫ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয় গাড়িটি কিনতে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট থেকে বরাদ্দ অনুমোদন করে বোর্ড। 

বাপেক্সের বোর্ড সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের লক্ষ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, মন্ত্রণালয়, আইএমইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা মাঝেমধ্যে মাঠপর্যায়ে যাতায়াত করেন। মানসম্মত গাড়ি না থাকায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গাড়ি সরবরাহ সম্ভব হয় না। তাই তাঁদের ব্যবহার উপযোগী একটি গাড়ি কেনা দরকার। 

বাপেক্সের তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. নূরুল আলম গত ২৯ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। তাই গাড়ি কেনার দরকার ছিল। তবে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য কেনার কথা লেখা থাকলে, সেটা ভুল হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না থাকায় সরকার পরিবর্তনের পর গাড়িটি সরবরাহ না নিতে মৌখিকভাবে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন। 

কোম্পানি স্বাধীন হলেও সরকারি সব নির্দেশনা মানতে বাধ্য। কিন্তু কোম্পানির বোর্ড ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। এখানে ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত থাকতে পারে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম

নূরুল আলম আরও বলেন, তাঁর জন্য গাড়ি কেনার দরকার ছিল না। সচিব হিসেবে তিনি সরকারিভাবে গাড়ি পেয়েছেন, এর বাইরে তিতাস থেকেও একটি গাড়ি বরাদ্দ ছিল তাঁর নামে। 

বাপেক্স সূত্র বলছে, সোয়া চার কোটি টাকায় গাড়িটি কেনা হয় উন্মুক্ত দরপত্রপ্রক্রিয়ায়, কাজ পায় একটি বেসরকারি কোম্পানি। গাড়িটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসের আগেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর বেশ কিছুদিন গাড়িটি বন্দরে পড়ে ছিল। গাড়ি নিয়ে করণীয় ঠিক করতে সময় নেয় বাপেক্স। এরপর সরবরাহকারী কোম্পানির চাপে গাড়িটি বন্দর থেকে খালাস করে ঢাকায় আনা হয়। তবে সরবরাহকারী কোম্পানির কাছ থেকে এখনো গাড়িটি বুঝে নেননি বলে দাবি করেছেন বাপেক্সের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা। তিনি বলেন, গাড়িটি নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে। গাড়িটি আসলে কোথায় আছে, তা কেউ পরিষ্কার করে বলছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছেন তাঁরা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানি স্বাধীন হলেও সরকারি সব নির্দেশনা মানতে বাধ্য। কিন্তু কোম্পানির বোর্ড ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। এখানে ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত থাকতে পারে। যথাযথভাবে খতিয়ে দেখা হলে এমন আরও অনিয়ম-দুর্নীতি বেরিয়ে আসতে পারে।