বিজেএমসি: বসে বেতন নিচ্ছেন ২ হাজার কর্মী

  • ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ বিজেএমসি খরচ করেছে ১৩৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

  • ওই অর্থবছরে এই করপোরেশন লোকসান দেয় ১৮০ কোটি ২১ লাখ টাকা।

বিজেএমসি

রাজধানীর ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলস লিমিটেড ২০২০ সালের ১ জুলাই বন্ধ হয়ে যায়। চার বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী এই প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে নেই। তবে এখনো প্রতিষ্ঠানটিতে ১৮৪ কর্মকর্তা–কর্মচারী (৭৬ কর্মকর্তা, ১০৮ কর্মচারী) রয়ে গেছেন। সরকারকে প্রতি মাসে তাঁদের পেছনে বেতন–ভাতা বাবদ বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়।

লতিফ বাওয়ানীর এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন বন্ধের পর কারখানার শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়েছে; কিন্তু কর্মকর্তা–কর্মচারীরা রয়ে গেছেন। তাঁদেরও মূলত কাজ নেই। তাঁরা এখন পালাক্রমে কারখানা দেখভালের কাজ করেন।

লতিফ বাওয়ানীসহ বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) চালু থাকা ২৫টি পাটকল ২০২০ সালের ১ জুলাই বন্ধ করে দেয় সরকার। এসব কারখানার শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়। তবে কর্মকর্তা–কর্মচারীরা রয়ে গেছেন। বিজেএমসির জনসংযোগ দপ্তর জানিয়েছে, সব কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলেও এখনো বিজেএমসিতে ২ হাজার ৩৪৭ কর্মকর্তা–কর্মচারী দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের মধ্যে ৮৯৮ জন কর্মকর্তা এবং ১ হাজার ৪৪৯ জন কর্মচারী।

সব কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলেও এখনো বিজেএমসিতে ২ হাজার ৩৪৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।

সূত্র জানায়, গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন বাবদ বিজেএমসি খরচ করেছে ১৩৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এই অর্থবছরে এই করপোরেশন লোকসান দেয় ১৮০ কোটি ২১ লাখ টাকা।

বিজেএমসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সব পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার পর একটি আইন করে উদ্বৃত্ত কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সরকারের অন্য কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে সেই আইন এখনো পাস হয়নি। তাই কাউকে স্থানান্তর করা সম্ভবও হয়নি। ফলে এই উদ্বৃত্ত কর্মকর্তা–কর্মচারীর কী হবে তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলতে পারবে।

তবে কর্মকর্তাদের একটি অংশ হিসাবসহ এ রকম কিছু শাখায় কাজ করছে। তাদের কিছু কাজ রয়েছে।

বিজেএমসির চেয়ারম্যান ফারুক আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘উৎপাদন না থাকায় আমাদের এত কর্মকর্তা–কর্মচারীর দরকার নেই। সরকারের নির্দেশনা এলে প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা–কর্মচারী রেখে বাকিদের স্থানান্তর করা হবে।’

অবশ্য শ্রমিকদের মতো কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে বিদায় করা যেতে পারে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

শ্রমিকদের মতো বিজেএমসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও দেনা–পাওনা মিটিয়ে বিদায় করে দেওয়া যেতে পারে
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

পাটকল ভাড়ায় যাচ্ছে

৭৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল পরিচালনার জন্য ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করে বিজেএমসি। একপর্যায়ে করপোরেশনটির কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় ৮২টিতে। তারপর হস্তান্তর, পুঁজি প্রত্যাহার ও বিক্রির পর বর্তমানে বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৩১টি কারখানা। এর মধ্যে ২৫টি পাটকল চালু ছিল, যা ২০২০ সালে সরকার বন্ধ করে দেয়। ২৫টির মধ্যে ২০টি কারখানা ভাড়া দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, ইতিমধ্যে ১৪টি পাটকল ভাড়া দেওয়া হয়ে গেছে। ভাড়া দেওয়া পাটকলগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ভাড়া মাসিক ৪ লাখ টাকা, আর সর্বোচ্চ ভাড়া মাসিক ৪০ লাখ টাকা। জমি, অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতির ওপর ভিত্তি করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।

অবশ্য ১৪টির মধ্যে ৭টি পাটকল উৎপাদনে গেছে, যারা পাটজাত বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করছে। তবে ভাড়া দেওয়া সাতটি পাটকল এখনো উৎপাদনে যায়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, যেসব প্রতিষ্ঠান পাটকলগুলো ভাড়া নিয়েছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটির পাটজাত পণ্য উৎপাদনের অভিজ্ঞতা নেই। তাদের মধ্যে কয়েকটি উৎপাদনে যেতে হিমশিম খাচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, যারা উৎপাদনে যাচ্ছে না, তারা কোন উদ্দেশ্যে ভাড়া নিয়েছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত।

বিজেএমসি কর্তৃপক্ষ বলছে, গ্রেস পিরিয়ডের (এই সময়ের মধ্যে ভাড়া দিতে হবে না) এ সময়ের মধ্যে কোনো পাটকল উৎপাদনে যেতে না পারলে সেই চুক্তি বাতিল, জামানত বাজেয়াপ্ত করাসহ নানাধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আছে। কারখানাপ্রতি জামানত হিসেবে ৩৬ মাসের ভাড়া অগ্রিম রাখা হচ্ছে।

 বিজেএমসির চেয়ারম্যান দপ্তর জানিয়েছে, প্রতিটি কারখানাকে ৩০ মাসের গ্রেস পিরিয়ড দেওয়া হয়েছে। এই গ্রেস পিরিয়ড পেরিয়ে মাত্র দুটি কারখানা ভাড়া দেওয়া শুরু করেছে।

২০২০ সালে বন্ধ হওয়া যে পাঁচটি কারখানা ভাড়া দেওয়ার উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি, এর মধ্যে দুটি কারখানার ব্যবস্থাপনা ও মালিকানা–সংক্রান্ত মামলা চলমান। আর ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় থাকা তিনটি কারখানা ভাড়া না দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত রয়েছে।

বেতন দিতেও হিমশিম

বিজেএমসির চেয়ারম্যান বরাবর গত ৩১ জুলাই দাবিদাওয়া তুলে ধরে একটি চিঠি দেয় বাংলাদেশ পাটশিল্প কর্মকর্তা সমিতি। তাতে বলা হয়, প্রায় চার বছর ধরে বিজেএমসির পণ্য বিক্রির অর্থ থেকে বেতন–ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে; কিন্তু গত এপ্রিল মাস থেকে তিন মাস ধরে বেতন–ভাতা বন্ধ থাকায় সবাই মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ বিষয়ে বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়সহ অর্থ মন্ত্রণালয়েও যোগাযোগ করা হয়েছে; কিন্তু আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় নিয়মিত বেতন–ভাতা দেওয়া নিশ্চিত করা, পদোন্নতিসহ সব প্রাপ্য বাস্তবায়ন করা এবং অতিরিক্ত জনবল আত্তীকরণের বিষয়টি দ্রুত বাস্তবায়ন করার দাবি জানানো হয়।

জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকদের মতো বিজেএমসির কর্মকর্তা–কর্মচারীদেরও দেনা–পাওনা মিটিয়ে বিদায় করে দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, করপোরেশনের আকার ছোট করে মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি ছোট আকারের অফিস নেওয়া যেতে পারে, যাঁরা করপোরেশনের সামগ্রিক বিষয় তত্ত্বাবধান করবেন।