প্রথম ঘোষণা হয়েছিল লালদীঘিতে

ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণার দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে লালদীঘি ময়দানে নির্মিত মঞ্চফাইল ছবি

লালদীঘির পাড় থেকে হেঁটে সাত মিনিটের পথ বক্সিরহাট মোড়। মোড়ের কাছেই বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ চৌধুরীর বাড়ি। তাঁর কাছে গিয়েছিলাম ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘির পাড়ে অনুষ্ঠিত ৬ দফার প্রথম জনসভা সম্পর্কে জানতে। তিনি সেই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন।

আমরা ইতিহাস থেকে জানি, ৬ দফা দাবির কথা আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধু প্রথম উত্থাপন করছিলেন ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তখনকার  লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলের বৈঠকে। ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকা ফিরে আসেন। সেদিনই তিনি সংবাদ সম্মেলন করে ৬ দফা কর্মসূচির কথা জাতিকে জানিয়ে দেন। কিন্তু আপামর জনতার সামনে, প্রথম সমাবেশ করে ৬ দফা দাবির ঘোষণা আসে কয়েক দিন পর। সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি দেওয়া হয়েছিল চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে। এখানেই প্রথম জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

নুর মোহাম্মদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম সেদিনের কোনো স্মৃতি মনে আছে কি না। নুর মোহাম্মদ তখন ২৬ বছরের টগবগে যুবক। ৫৫ বছর আগের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে নিজেও যেন ফিরে গেলেন যৌবনে। তিনি বললেন, ‘সেই দিনের কথা ভুলতে পারি না। তখন বুঝতে পারিনি, এখন বুঝতে পারি আমরা একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। সেদিন ছিল শুক্রবার। শেখ মুজিবুর রহমানসহ নেতারা এসেছিলেন সকালে। তিনি উঠেছিলেন হোটেল শাহজাহানে।  ৬ দফার জনসভার কথা মনে পড়লে দুটি বিষয় বেশি মনে পড়ে। একটি হলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। ভাষণে তিনি অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়ে দিয়েছেন ৬ দফায় কী কী আছে। আরেকটি হলো গায়ক শফি ভান্ডারীর গান। সন্দ্বীপের গায়ক শফি সেদিন গানের সুরে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন ৬ দফার মর্মকথা। সেই সুর এখনো যেন প্রাণের ভেতর বেজে ওঠে।’

নুর মোহাম্মদ বলেন, সেদিন ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি’ শিরোনামের একটি পুস্তিকা বিলি করা হয়। পুস্তিকাটির লেখক শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫ পয়সা দামের এই পুস্তিকার পেছনে লেখা ছিল, ‘তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষে ১৫ পুরানা পল্টন, ঢাকা হইতে প্রকাশিত।’

ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্ত শাসনের দাবিতে নারীরাও নেমে এসেছিল পথে
ছবি: সংগৃহীত

বইটিতে ৬ দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লেখেন ‘আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে ও সভা-সমিতির বিবরণে সকল শ্রেণির সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি। তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে।’

লালদীঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত ৬ দফার জনসভা সম্পর্কে চট্টগ্রামের প্রবীণ সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে তো ছিলই, তখন রাজনৈতিকভাবেও চট্টগ্রাম খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ কারণে ৬ দফার প্রথম জনসভাটি এখানে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব ছাড়াও সেদিনের সভায় বক্তব্য দেন খন্দকার মোশতাক আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম এ আজিজ, আবদুল্লাহ আল হারুন। সভাশেষে সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরী সভার লিখিত প্রস্তাব পাঠ করেন।

 সে সময়ের শহর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ইদরিস আল ইদরিস আলম তাঁর স্মৃতিকথায় লেখেন, ‘শেখ সাহেব ৬ দফা আন্দোলনের শুরুতে প্রথম চট্টগ্রামে জনসভা অনুষ্ঠানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে ২৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার লালদীঘি ময়দানে জনসভার আয়োজন করা হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন জহুর আহমদ চৌধুরী। ৬ দফার এই প্রথম সভার প্রস্তাবগুলি আমিই লিখি। দুই নম্বর প্রস্তাবে বলা হয়, এই সভা পূর্ব পাকিস্তানের সিংহহৃদয় বঙ্গশার্দূল সংগ্রামী জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৬ দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাইতেছে এবং ৬ দফার ভিত্তিতে দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়িয়া তোলার জন্য জনসাধারণের কাছে আবেদন জানাইতেছে এবং পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি উক্ত ৬ দফাকে কর্মসূচি হিসাবে গ্রহণ করার জন্য তাহাদেরও মোবারকবাদ জ্ঞাপন করিতেছে। যে সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঐতিহাসিক ৬ দফাকে কেন্দ্র করিয়া সমালোচনার মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝির প্রয়াস পাইতেছে, তাহাদের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে ৬ দফার সঠিক অর্থ অনুধাবন করিয়া রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিবার জন্য আহ্বান জানাইতেছে। এই সভা মনে করে, ৬ দফার মধ্যেই অন্তর্নিহিত রহিয়াছে শক্তিশালী পাকিস্তান গড়িয়া তোলার স্বপ্ন।’

৬ দফার জনসভার মাধ্যমে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে লালদীঘির নামটা যুক্ত হয়েছে এভাবেই।