সড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ
বারবার বিকল, তবু নতুন কেন্দ্র
মহাসড়কগুলোতে বসানো ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের বেশির ভাগ বিকল থাকে। নতুন ২৮টি স্থাপনে ব্যয় ১,৬৩০ কোটি টাকা। যদিও শিংপাড়া থেকে ১৫ কিলোমিটারের মতো দূরে মহাসড়কটির দশমাইল এলাকায় এখন আরেকটি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের নির্মাণের কাজ চলছে। ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা।
পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের শিংপাড়া এলাকায় প্রায় সাড়ে আট বছর আগে একটি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন বসানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, সড়কটিতে সীমার চেয়ে বেশি ওজন নিয়ে যানবাহন চলাচল ঠেকানো।
অবশ্য উদ্বোধনের মাত্র তিন দিনের মাথায় ৫৫ লাখ টাকার যন্ত্রটি বিকল হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত তা মেরামত করা হয়নি। যদিও শিংপাড়া থেকে ১৫ কিলোমিটারের মতো দূরে মহাসড়কটির দশমাইল এলাকায় এখন আরেকটি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের নির্মাণের কাজ চলছে। ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা।
ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বিকল থাকার এই চিত্র শুধু পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কে নয়, দেশের বিভিন্ন সড়কে দুই দশকে ১৮টি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮টি স্থায়ী ও ১০টি স্থানান্তরযোগ্য (পোর্টেবল)। কিন্তু এখন মাত্র পাঁচটি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র চালু আছে। কেন্দ্রগুলো বসানোর পর অল্প সময়ে বিকল হয়ে গেছে। কোনো কোনো কেন্দ্র বিকল হওয়ার পর বারবার টাকা খরচ করে মেরামত করা হয়েছে। তারপরও বেশির ভাগই এখন অকেজো।
পুরোনোগুলো যখন অকেজো, তখন ২০১৯ সালে বিভিন্ন জেলায় ২৮টি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনে একটি প্রকল্প নেয় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। এতে ব্যয় হবে ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৪০ শতাংশ। এর বাইরে ২০১৩ সাল থেকে সড়ক ও সেতু নির্মাণের বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে আরও ১৩টি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগের কাজ শেষ পর্যায়ে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বিকল থাকার এই চিত্র শুধু পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কে নয়, দেশের বিভিন্ন সড়কে দুই দশকে ১৮টি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮টি স্থায়ী ও ১০টি স্থানান্তরযোগ্য (পোর্টেবল)। কিন্তু এখন মাত্র পাঁচটি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র চালু আছে। কেন্দ্রগুলো বসানোর পর অল্প সময়ে বিকল হয়ে গেছে। কোনো কোনো কেন্দ্র বিকল হওয়ার পর বারবার টাকা খরচ করে মেরামত করা হয়েছে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, সওজ অধিদপ্তর ও পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন এখন আর সড়ক ভালো রাখার চিন্তা থেকে হচ্ছে না। কেনাকাটা, কমিশন-বাণিজ্য—এটাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ট্রাকচালকেরা বলছেন, ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে নানা কৌশলে বাড়তি ওজন নিয়ে পার হওয়া যায়। বেশি ওজনধারী ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি করা হয়। সরেজমিনে এই অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ আন্তজেলা ট্রাক চালক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রগুলো চাঁদাবাজির একটা আখড়া। যে কয়টি স্টেশন চালু আছে, সব কটিতে হয়রানির শিকার হতে হয়।
পুরোনোগুলো যখন অকেজো, তখন ২০১৯ সালে বিভিন্ন জেলায় ২৮টি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনে একটি প্রকল্প নেয় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। এতে ব্যয় হবে ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৪০ শতাংশ।
কেন ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র
একটি পণ্যবাহী যানে সক্ষমতার চেয়ে বেশি পণ্য বহন করলে রাস্তা ও সেতুর ক্ষতি হয়। এ জন্য কত চাকার যানবাহন কত ওজন নিতে পারবে, তা ঠিক করা আছে। যেমন ৬ চাকার যানে সর্বোচ্চ ১৫ টন টন পণ্য বহন করা যায়। উল্লেখ্য, দেশে ৬ থেকে ২৬ চাকার যান দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হয়। সীমার বেশি পণ্য নিলে ২ থেকে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করার সুযোগ রয়েছে।
দেশের মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলো টেকসই না হওয়ার একটি কারণ হিসেবে সীমার অতিরিক্ত পণ্য নিয়ে যান চলাচলকে দায়ী করে সওজ। সংস্থাটি নতুন সড়ক নির্মাণের পর এর আয়ুষ্কাল ধরে সর্বোচ্চ ২০ বছর। কিন্তু দেখা যায়, দেশের মহাসড়কগুলো কয়েক বছর পরপর মেরামত করতে হয়। এতে বিপুল ব্যয় হয় সরকারের। সওজের ২০১৭ সালের হিসাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা টোল প্লাজা হয়ে চলাচলকারী ৪০ শতাংশ ট্রাক বাড়তি পণ্য নিয়ে চলাচল করছিল।
বৃষ্টি হলে অনেক সময় ওজন স্কেলের নিচে বালু ও মাটি জমে যায়। তখন লেন বন্ধ করে পরিষ্কার করতে হয়।
ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের মূল যন্ত্র ওজন পরিমাপক বা স্কেল। কেন্দ্রে সংকেত বাতি, জেনারেটর, কম্পিউটার, প্রশাসনিক ভবন, বাড়তি পণ্য নামিয়ে রাখার জায়গা ও অন্যান্য সুবিধা থাকে।
বিকল যেসব কেন্দ্র
ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের মূল যন্ত্র ওজন পরিমাপক বা স্কেল। কেন্দ্রে সংকেত বাতি, জেনারেটর, কম্পিউটার, প্রশাসনিক ভবন, বাড়তি পণ্য নামিয়ে রাখার জায়গা ও অন্যান্য সুবিধা থাকে।
সড়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানান্তরযোগ্য ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনে ৫০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। স্থায়ীগুলোর প্রতিটির খরচ ৫ থেকে ২০ কোটি টাকা।
বগুড়ার মহাস্থানগড়ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চালুর এক সপ্তাহের মধ্যে বিকল হয় একটি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। দুই বছর পর মেরামত করে চালু করা হয়। তখন সপ্তাহখানেক টেকে। এখন ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দী করে সওজের গুদামে ফেলে রাখা হয়েছে। গাজীপুর-ইটাখোলা সড়কে শীতলক্ষ্যা নদীতে চরসিন্ধুর সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ২০১৮ সালে দুটি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বসানো হয়। এগুলো কখনো চালু, কখনো বিকল থাকে।
২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পুরোনো ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে যন্ত্রপাতি নতুন করে বসিয়ে উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু বেশি দিন তা চলেনি। ২০১৬ সালে পুনরায় সেটি মেরামত করে উদ্বোধন করা হয়। এখন কেন্দ্র সচল আছে। তবে মাঝেমধ্যে সমস্যা হয়। সওজের সীতাকুণ্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টি হলে অনেক সময় ওজন স্কেলের নিচে বালু ও মাটি জমে যায়। তখন লেন বন্ধ করে পরিষ্কার করতে হয়।
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রতিটি যানবাহন কত ওজন বহন করতে পারবে, তা ঠিক করে দেয়। সরকার কীভাবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ঠিক করে দেওয়া ওজনের বেশি অনুমোদন দেয়? এর ফলে ক্ষয়ক্ষতি ও নিরাপত্তাঝুঁকির দায় তো সরকারের। আসলে লুটপাটের জন্যই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়।
২০১৪ সালে মানিকগঞ্জের বাথুলিতে একটি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র যন্ত্রপাতি বসিয়ে পুনরায় চালু করা হয়েছিল। এটি এখন বিকল। ২০১৩ সালের শেষ দিকে হবিগঞ্জে স্থাপিত ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রটি পুনরায় চালু করা হয়। কিন্তু দুই মাস চলেছে। ২০১৩ সালে একবার, পরে ২০১৬ সালে মেঘনা-গোমতী নদীর দুই পাড়ের ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র চালু করা হয়। কিন্তু কদিন পরপরই বিকল থাকে এগুলো। ঢাকা-মাওয়া সড়কের ধলেশ্বরীতে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রটি মহাসড়ক সম্প্রসারণের সময় ফেলে দেওয়া হয়।
আগে স্থাপন করা ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র দিয়ে কী অর্জন হয়েছে, এর কোনো মূল্যায়ন নেই সওজ বা সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের। এরপরও ১৯ জেলায় ২৮টি নতুন ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প নেয় সওজ। ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকার প্রকল্পের পুরোটা ব্যয় রাজস্ব খাত থেকে বহন করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের গতি বেশ ধীর।
প্রকল্পের নথি থেকে জানা গেছে, এসব ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র নির্মাণে ৭৬৫ কোটি টাকায় ৬৪ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের কথা রয়েছে। বাকি ৮৬৫ কোটি টাকা ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি কেনা, পূর্তকাজের জন্য রাখা হয়েছে। পরামর্শকের জন্য ৫৫ কোটি ও বিদেশে ভ্রমণের জন্য ২ কোটি ১০ লাখ বরাদ্দ রয়েছে প্রকল্পে। আর এক কোটি টাকা ব্যয় হবে অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণে।
প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স এবং স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত নির্মাণকাজের মধ্যে রয়েছে দ্বিতল ভবন, ওয়্যারহাউস, পার্কিং এরিয়া, বুথ, সড়ক বাঁধ, নালা ও বক্স কালভার্ট, বৈদ্যুতিক কাজ ইত্যাদি। চালকদের জন্য পার্কিং, যানবাহনের মালামাল নামানোর স্থান, বিশ্রামাগার, ক্যাফেটেরিয়া, শৌচাগার, প্রার্থনার স্থান ইত্যাদিও থাকবে।
এর বাইরে সড়ক ও সেতু নির্মাণের বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে ১৩টি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বসানো হচ্ছে যশোরের বেনাপোল, পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়, টাঙ্গাইলের পাকুল্লা, রংপুরের ইসলামপুর, বগুড়ার মহাস্থানগড়, পঞ্চগড়ের দশমাইল, সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর বাইপাস, সিলেটের লামাকাজি সেতু এলাকা, সুনামগঞ্জের রানীগঞ্জ সেতু এলাকা, সিলেট-তামাবিল সড়কের বাগের বাজার এলাকায় (দুটি), জামালপুরের জগন্নাথগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের সোনাহাটে।
একদিকে নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে শিথিল
সরকার একদিকে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বসিয়েছে, অন্যদিকে যানবাহনে পণ্য বহনের ওজনসীমা শিথিল করা হয়েছে। ২০১২ সালে ওজন নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা করা হয়। ২০১৬ সালের আগস্টে নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে জরিমানা আদায় শুরু করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রথম দিনই সীতাকুণ্ড ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র পুড়িয়ে দেন পণ্যবাহী গাড়ির চালক ও তাঁদের সহকারীরা। পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা ধর্মঘটের ডাক দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ওজন সীমা বাড়িয়ে দেয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। তখন বলা হয়, ৬ চাকার যানবাহনে সর্বোচ্চ ২২ টন পণ্য পরিবহন করা যাবে। বাড়তি নিলে জরিমানা হবে। কিন্তু এখন তেমন একটা জরিমানা হয় না বলে জানা গেছে।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত আদেশে বলেছিল, ওজন সীমা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি সাময়িক। প্রায় ছয় বছর পরও তা রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রতিটি যানবাহন কত ওজন বহন করতে পারবে, তা ঠিক করে দেয়। সরকার কীভাবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ঠিক করে দেওয়া ওজনের বেশি অনুমোদন দেয়? এর ফলে ক্ষয়ক্ষতি ও নিরাপত্তাঝুঁকির দায় তো সরকারের। আসলে লুটপাটের জন্যই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]