সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা মো. শাহীনকে বাঁচানোর আশা নিয়ে তাঁর স্বজনেরা গতকাল মঙ্গলবার রাতে এসেছিলেন ঢাকায়। মুমূর্ষু শাহীনকে অ্যাম্বুলেন্সে করে রাতভর তাঁরা ঘুরেছেন এ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে। কিন্তু কোথাও তাঁকে ভর্তি করতে পারেননি। অবশেষে বিনা চিকিৎসায় মারাই গেলেন শাহীন।
শাহীন এক হতদরিদ্র নাগরিক। গ্রামের বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার মোটবি ইউনিয়নে। বাবা মুন্সী মিয়া। ৩৮ বছর বয়সী শাহীন ২৩ এপ্রিল রোববার অর্থাৎ, পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরদিন সকালে ফেনী শহরের অদূরে এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় মারাত্মকভাবে আঘাত পান। গাছের সঙ্গে ধাক্কায় তাঁর মাথার একাংশ থেঁতলে যায়।
স্বজনেরা জানান, গুরুতর আহত অবস্থায় শাহীনকে প্রথমে ফেনী শহরের জেড ইউ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য এই হাসপাতালের চিকিৎসা-সরঞ্জাম যথেষ্ট নয়। তাঁরা দ্রুত রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলেন। এ অবস্থায় অক্সিজেন লাগিয়ে শাহীনকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে তাঁকে ভর্তি করা যায়নি। কারণ, এই রোগীর জন্য যে আইসিইউ সুবিধা দরকার, সেই শয্যা চট্টগ্রাম মেডিকেলে ফাঁকা নেই। তখন শাহীনকে শহরের সিএসটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা আছে। রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন দেখে সেখানকার চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা বা অন্য কোথাও নিতে। কিন্তু স্বজনেরা জানান, শাহীন একেবারেই হতদরিদ্র। গ্রামে তাঁদের ঘর-ভিটাও নেই। অন্যের বাড়ির (সাবেক এক ইউপি চেয়ারম্যান) পরিত্যক্ত রান্নাঘরে স্ত্রী-সন্তান আর বাবাসহ আশ্রয়ে আছেন।
স্বজনদের একজন এই প্রতিবেদককে জানান, সব শুনে ওই হাসপাতালের চিকিৎসক ও ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের কেউ কেউ শাহীনকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। হাসপাতালে ঘণ্টায় ৭৮ হাজার টাকা বিল আসে। কর্তৃপক্ষ ছাড় দিয়ে এই বিল ৬০ হাজার টাকা করে। স্বজনেরা দোটানায় পড়েন শাহীনকে বাড়ি নেবেন, নাকি ঢাকায় আনবেন। অবস্থা এমন—অক্সিজেন–সংযোগ খুলে ফেললেই রোগী মারা যাবেন। স্বজনেরা ভাবলেন, শাহীন বাঁচার জন্য লড়াই করছেন। অক্সিজেন খুলে কেন তাঁকে মেরে ফেলা হবে। তাঁরা ঢাকায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়ে রওনা হন। সঙ্গে শাহীনের এক ছেলে, দুই শ্যালক ও এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আসেন।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে এই প্রতিবেদকের মুঠোফোনে একটি কল আসে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। ফোনটি করেন প্রতিবেদকের এলাকার ছেলে হারুন রশীদ। শাহীনদের বাড়ির পাশেই হারুনদের বাড়ি। হারুন বড় আশা নিয়ে ফোন করে অনুরোধ করে বলেন, ‘সাংবাদিক ভাই, এলাকার একজন মুমূর্ষু রোগী ঢাকার হাসপাতালে আসছে, নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।’ সৌদি আরব থেকে এক নিকটাত্মীয়কে দিয়েও ফোন করান হারুন।
রাত সাড়ে ৯টার দিকে শাহীনকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ায় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের ভেতরের ফটকে। শাহীনের স্বজনেরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যোগাযোগ করেন। চিকিৎসকেরা জানান, তাদের আইসিইউর শয্যা খালি নেই।
স্বজনদের পীড়াপীড়িতে একজন চিকিৎসক অ্যাম্বুলেন্সে এসে শাহীনকে দেখে যান। অবস্থা দেখে তিনি পরামর্শ দেন রোগীকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার। এর মধ্যে কেটে যায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা। হতাশ হয়ে স্বজনেরা ঢাকা মেডিকেলে যান। শাহীনকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। তাৎক্ষণিক অক্সিজেন–সহায়তা দিতে সেখান থেকে একটি সিলিন্ডার কেনা হয়। রোগীর অবস্থা দেখে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর আইসিইউ সুবিধা লাগবে। এই মুহূর্তে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই। শাহীনকে আবার ঢোকানো হয় অ্যাম্বুলেন্সে। হন্যে হয়ে স্বজনেরা নানা মাধ্যমে এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতালে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন। রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত শাহীন ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে ছিলেন।
তখন মধ্যরাত। ফেনী থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকায়। এরপর শাহীনকে কোথায় নেবেন? এক মাধ্যমে স্বজনেরা খবর পান, ধানমন্ডির একটি প্রাইভেট হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি আছে। রাত দেড়টায় তাঁকে নেওয়া হয় সেখানে। স্বজনদের ধারণা ছিল, বাকি রাত বা পরদিন দুপুর পর্যন্ত ১০-১২ হাজার টাকা গেলেও বুধবারে একটা ব্যবস্থা হবেই। রোগীর অবস্থা দেখে তারাও ভর্তি করতে গড়িমসি করেন। বললেন, এক দিনে চিকিৎসাসহ আনুষঙ্গিক মিলে ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ পড়ে যাবে।
ঢাকার কোনো হাসপাতালেই শাহীনের জায়গা হয়নি। রাজ্যের হতাশা নিয়ে স্বজনেরা রাত দেড়টায় আবার ফেনীর উদ্দেশে রওনা দেন। ভোর পাঁচটার দিকে তাঁরা ফেনী সদর হাসপাতালে পৌঁছান। শেষ চেষ্টা হিসেবে শাহীনকে সেখানে ভর্তির নানা চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হন স্বজনেরা। তবে শাহীনকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অক্সিজেন দিয়ে রাখা যায়—এটুকুই। কিন্তু ভর্তি করা যায়নি। সব চেষ্টা বিফলে যায়। হতাশ স্বজনেরা তখন ক্লান্ত, অবসন্ন, বিমর্ষ। কোথাও ঠাঁই না পাওয়া শাহীন দুপুর ১২টায় ফেরেন নিজ গ্রামে। জীবনযুদ্ধে হেরে বেলা সাড়ে তিনটায় চিরবিদায় নেন তিনি।
দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর ফেনী থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায়—চার দিনে এই জীবন–মরণ লড়াইয়ে শাহীনের সঙ্গে ছিলেন প্রতিবেশী ও বন্ধু শফিউল আজম (দীপু)। তিনি ফেনীর পূর্বাঞ্চলে একজন ভালো ফুটবলার হিসেবে পরিচিত। আক্ষেপ করে শফিউল আজম প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থায় গরিব মানুষেরা যে কতটা অসহায়, তা বুঝিয়ে দিলেন শাহীন।