‘চোখেমুখে হাসত ছেলেটা, নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে সে আন্দোলনে গিয়েছিল’

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ চলাকালে ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র মীর মাহফুজুর রহমান (মুগ্ধ)ছবি: সংগৃহীত

বিছানার পাশেই ফ্রিল্যান্সার দুই ভাইয়ের দুটি বড় টেবিল, চেয়ার আর কম্পিউটার। চেয়ার দুটি এমনভাবে রাখা যে কাজ করতে করতে কেউ ক্লান্ত হয়ে গেলে চেয়ার পেছন দিকে নিয়ে একজন আরেকজনের ঘাড়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিতেন। যমজ এই দুই ভাইয়ের একজন মীর মাহফুজুর রহমান (মুগ্ধ) আর নেই। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উত্তরার আজমপুরে সংঘর্ষের মধ্যে ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন তিনি।

মুগ্ধর অনুপস্থিতিতে এই কয়েক দিনে তাঁর টেবিল, চেয়ারে খানিকটা ধুলা পড়েছে। বড় একা হয়ে গেছেন তাঁর যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান (স্নিগ্ধ)। দুই ভাই জন্মের পর ২৫ বছর ৯ মাস ১৪তম দিনও একসঙ্গে কাটিয়েছেন। পরের দিনটিতে মুগ্ধ তাঁদের ছেড়ে গেছেন জানিয়ে স্নিগ্ধ বললেন, ‘মুগ্ধ তো শুধু আমার ভাই ছিল না, বন্ধু ছিল। ওর সব গোপন কথা, দুজনের মোবাইলের পাসওয়ার্ড থেকে শুরু করে সব তথ্য জানতাম দুজন।’ তাঁদের চেহারায় ছিল খুব বেশি মিল। এমনকি ‘ফেস লক’ করা মুগ্ধর মোবাইল স্নিগ্ধর মুখের কাছে নিলে সেটি খুলে যায়।

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ২০২৩ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে স্নাতক শেষ করেন। ঢাকায় ফিরে মার্চ মাসে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি)। প্রফেশনাল এমবিএ করছিলেন। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করতেন তিনি। তাতে আয়ও বেশ হতো।

রোববার রাজধানীর উত্তরায় স্নিগ্ধ-মুগ্ধের ঘরে বসেই প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলছিলেন স্নিগ্ধ। এ সময় গায়ে থাকা হালকা সবুজ রঙের শার্টটি দেখিয়ে তিনি বললেন, এটা ছিল মুগ্ধর প্রিয় শার্টগুলোর একটি। মুগ্ধ বেঁচে থাকলে তাঁর শার্ট গায়ে দেওয়ার জন্য এতক্ষণে ক্ষেপে যেতেন। বড় বিছানা দেখিয়ে স্নিগ্ধ বললেন, এখন তিনি পুরো বিছানার মালিক। কিন্তু এত দিনের অভ্যাস, তাই ঘুমের মধ্যেও বিছানার একটি অংশ ফাঁকাই থাকে। মনে হয়, ভাই হয়তো ঘুমাচ্ছেন।

এই পরিচয়পত্র কাছে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন মীর মাহফুজুর রহমান (মুগ্ধ)। তাঁর ওই পরিচয়পত্রে লেগে আছে রক্তের দাগ
ছবি: মানসুরা হোসাইন

১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান মুগ্ধ। সেদিন তিনি লেমিনেটিং করা বিইউপির আইডি কার্ড (পরিচয়পত্র) গলায় ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। গুলি লাগার পর আইডি কার্ডের ভেতরে রক্ত ঢুকেছিল। রক্ত শুকিয়ে গেছে। মুগ্ধর পরিবারের সদস্যরা রক্তমাখা কার্ডটি সেভাবেই রেখে দিয়েছেন।

মুগ্ধর বড় ভাই মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মীর মাহমুদুর রহমান (দীপ্ত) এই আইডি কার্ডসহ মুগ্ধর সংগ্রহে রাখা অন্য কার্ড, সনদসহ অন্যান্য স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দেখালেন। বললেন, মুগ্ধ স্মৃতি জমিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন। তাই কোনো জিনিস ফেলতেন না। এখন তো মুগ্ধ নিজেই স্মৃতি হয়ে গেলেন।

পড়াশোনার পাশাপাশি ফুটবল খেলোয়াড়, গায়ক, গিটারিস্ট ও দক্ষ সংগঠক হিসেবে বেশ সুনাম ছিল মুগ্ধর। ছিলেন স্কাউট গ্রুপের ইউনিট লিডার। শ্রেষ্ঠ সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশ স্কাউটস থেকে পেয়েছেন ‘ন্যাশনাল সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’। বাইক নিয়ে ৩৪টি জেলার সার্কিট হাউসের সামনে ছবি তুলেছিলেন, চেয়েছিলেন সব জেলায় ঘুরবেন।

মুগ্ধর মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি হোক, চায় না পরিবার

বড় ভাই মাহমুদুর রহমান জানালেন, মুগ্ধর সঙ্গে থাকা বন্ধুদের বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁর কপালের মাঝখানে গুলি লেগে ডান কানের নিচ দিয়ে বের হয়ে যায়। উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে মুগ্ধ আন্দোলনকারীদের পানি আর বিস্কুট খাওয়াচ্ছিলেন—এমন একটি ভিডিও দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘মুগ্ধ আন্দোলনকারীদের কষ্ট সহ্য করতে পারছিল না। পারিবারিক আলোচনায় বাবা ও মায়ের সঙ্গে আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়েও কথা বলেছে। স্নিগ্ধ-মুগ্ধ দুই ভাই সব সময় মানুষের কষ্টে পাশে থাকার চেষ্টা করত। পরিবার থেকেও তাদের এ কাজকে সব সময় সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে।’

সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত মীর মাহফুজুর রহমানের (মুগ্ধ) নানা সনদ দেখান বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান (দীপ্ত)
ছবি: মানসুরা হোসাইন

গুলিতে মারা যাওয়ার আগে মুগ্ধ ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট দিয়েছিলেন। একটি পোস্টে জামায়াত-শিবির, ছাত্রদলের উদ্দেশে ছাত্র আন্দোলনটাকে রাজনৈতিক দলের আন্দোলন না বানানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্ট নিয়ে অনেকে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা তিন ভাই কখনোই সক্রিয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমার ভাই মানুষকে সহায়তা করতে গিয়ে গুলিতে মারা গেছে। তাই আমরা চাই না, কেউ আমার ভাইকে নিয়ে রাজনীতি করুক।’

মাহমুদুর রহমান জানান, গত ২৭ জুলাই শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীসহ অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের বাসায় এসেছিলেন পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে। ফেসবুকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীও মুগ্ধকে নিয়ে বিভিন্ন পোস্ট দিয়েছেন।

গুলিতে মারা যাওয়ার আগে মুগ্ধ আন্দোলনে সংঘর্ষে জাহিদুজ্জামান তানভীন নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর কথা লিখে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিলেন। ওই পোস্টে তিনি দেশের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, এই শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের মৃত্যুতে যে ক্ষতি হচ্ছে, তা কীভাবে পূরণ হবে।

‘কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে শাস্তি না পান’

মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান আস্তে করে বললেন, ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে আমাকে আর তার মাকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে ছেলে-মেয়েরা আমার ছেলেকে খুব পছন্দ করত। আমরা অসন্তুষ্ট হব, তেমন কোনো কাজ মুগ্ধ কখনো করেনি। চোখেমুখে হাসত ছেলেটা। কোটা আন্দোলন নিয়ে আমার অভিমত কী, তা জানতে চেয়ে সে কৌশলে আমার আর তার মায়ের কাছ থেকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি নিয়েছিল। নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে সে আন্দোলনে গিয়েছিল। আল্লাহই আমার ছেলে হত্যার বিচার করবেন।’

বড় ভাই মাহমুদুর রহমান দীপ্ত জানালেন, তাঁরা মুগ্ধর লাশের ময়নাতদন্ত করাননি। তাঁরা এ হত্যাকাণ্ডে কোনো মামলা করেননি বা করবেন না। তবে ঘটনার অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্ত চান। সেদিন ক্রিসেন্ট হাসপাতালসহ আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই সরকার বুঝতে পারবে সেদিনের ঘটনা। আর মুগ্ধর মৃত্যুর জন্য কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে শাস্তি না পান, এ আহ্বানও জানালেন তিনি।

সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত মীর মাহফুজুর রহমানের (মুগ্ধ) টেবিলে বসে আছেন তাঁর যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান (স্নিগ্ধ)
ছবি: মানসুরা হোসাইন

মুগ্ধ যেদিন মারা যান, সেদিন শুধু স্নিগ্ধ ঢাকায় ছিলেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা কক্সবাজারের উখিয়ায় ছিলেন। মাহমুদুর রহমান বললেন, ২০ জুলাই মুগ্ধ ও তাঁর বন্ধুদের সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল বলে মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ ঢাকায় ছিলেন। স্নিগ্ধ ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় মুগ্ধর মৃত্যুর খবর তাঁকে জানান। উখিয়া থেকে পরদিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি ঢাকায় ফেরেন।

মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘স্নিগ্ধ প্রথমে বলেছিল, মুগ্ধর শরীরে রাবার বুলেট লেগেছে। পরে জানায়, মুগ্ধ আর নেই। তখন বাবা ও মায়ের মোবাইল দুটি নিজের কাছে নিয়ে নিই, যাতে তাঁদের কেউ এ খবর জানাতে না পারেন। মায়ের হার্টের সমস্যা, সেখানে বসে মা এ খবর পেলে তাঁর অবস্থা কী হবে, তা নিয়েও চিন্তা করতে হয়েছে। তাঁদের শুধু বলেছি, মুগ্ধর আঘাত গুরুতর। পরে ঢাকায় ফিরে তাঁরা ছেলের লাশ দেখেন।’

স্নিগ্ধ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করেছেন। এখন বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বললেন, তাঁদের দুই ভাইয়েরই বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার ইচ্ছা ছিল। মুগ্ধ এ জন্য আইইএলটিএস কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর পছন্দের দেশ ছিল সুইজারল্যান্ড। এমবিএ শেষ করেই দেশের বাইরে চলে যেতে চেয়েছিলেন মুগ্ধ। আর তিন ভাই মিলে ভবিষ্যতে একটি আইটি কোম্পানি খুলতে চেয়েছিলেন।

স্নিগ্ধ-মুগ্ধ মানেই অনেক স্মৃতি

স্নিগ্ধ বললেন, ‘মুগ্ধর সঙ্গে তো অনেক স্মৃতি। যমজদের মধ্যে আলাদা একটা কানেকশন থাকে। তাই একজন কষ্ট পেলে অন্যজনও কষ্ট পেত। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আন্দোলনের বিভিন্ন ভিডিও দেখে বারবার মন খারাপ করছিল মুগ্ধ।’

জন্মের হিসাবে বয়সে স্নিগ্ধ বড় ছিলেন। মুগ্ধর ডান চোখের নিচে একটি কালো তিল আর স্নিগ্ধের একটু স্বাস্থ্য ভালো—এ দুটি ছাড়া তাঁদের আলাদা করা কঠিন ছিল। বাসায় পড়াতে আসা শিক্ষককেও বিভিন্ন সময় ফাঁকি দিয়েছেন তাঁরা। পাসপোর্ট করাতে গেলেও ঝামেলা হয়েছে একই ব্যক্তির দুই নাম কি না, তা নিয়ে। পরে পাসপোর্টের বড় কর্মকর্তার সামনে দুজনকে হাজিরা দিতে হয়েছে। দুই ভাই সব সময় একসঙ্গেই বিভিন্ন জায়গায় যেতেন, আড্ডা দিতেন। কোটা আন্দোলনে স্নিগ্ধরও যাওয়ার কথা ছিল, তবে এর আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আঙুলে ব্যথা পেয়েছিলেন বলে যাওয়া হয়নি।

এক বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে এভাবে ক্যামেরাবন্দী হয়েছিলেন যমজ ভাই মীর মাহফুজুর রহমান (মুগ্ধ) ও মীর মাহবুবুর রহমান (স্নিগ্ধ)
ছবি: সংগৃহীত

স্নিগ্ধ বললেন, ‘আমি আন্দোলনে যাচ্ছি না, আমি ভিতু, এসব বলে আমাকে অনেকক্ষণ খ্যাপাতে থাকে মুগ্ধ। তারপর আমাদের আরেক বন্ধুকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়। তবে সেদিনের বের হওয়াটা কেমন যেন লেগেছিল। বিকেল সাড়ে চারটার দিকেও একবার মনে হয়েছিল ফোন করে ভাইকে চলে আসতে বলি। পরে কাজের চাপে ফোন করা হয়নি। সেদিন যদি ফোনটা করতাম বা মুগ্ধর সঙ্গে আন্দোলনে যেতাম...।’

স্নিগ্ধ বললেন, ‘আমি প্রথমে ভেবেছিলাম মুগ্ধর মাথায় রাবার বুলেট লেগেছে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি, মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছে। আমি তখনো বুঝতে পারিনি ভাই নেই, হাসপাতালে তার বিছানার পাশেই বসি। চিকিৎসক এসে যখন বলেন, তখন বিশ্বাস করিনি। আমার সামনেই আবার ইসিজি করতে বলি। চিকিৎসক তা-ই করেন। তারপর তো মেশিনে নিজের চোখে দেখলাম...।’

মুগ্ধকে ছাড়া এখন বাকি জীবন কাটাতে হবে, এই সত্য মেনে নিতে হবে, এটা বুঝতে পারছেন স্নিগ্ধ। বললেন, ‘আমার ভাই, আমার সব থেকে ভালো বন্ধু নেই—এটা মেনে নিতে হবে। ভাইয়ের কথা কম চিন্তা করার চেষ্টা করি।’

মুগ্ধর মা শাহানা চৌধুরী এখনো মেনে নিতে পারছেন না তাঁর এক ছেলে নেই। বললেন, ‘অনেক কষ্ট করে যমজ দুই ছেলেকে বড় করেছি। এত কম বয়সে এক ছেলে এত কষ্ট দিয়ে চলে যাবে, তা বুঝতে পারিনি। ছেলেদের রুমে যেতে পারি না, অনেক কষ্ট হয়। একটু পরপর মনে হয়, এই বুঝি মুগ্ধ ঘরে ঢুকল। আমার এ কষ্টের ভাগ কেউ নিতে পারবে না।’