ভয় কাটিয়ে বিনা মূল্যের টিকা নিচ্ছেন তাঁরা
‘হুনছি, এই টিকার অনেক দাম। নিজেও কিন্যা দেতে পারমু না। তাই অরে নিয়া আইছি। আপারা (টিকাদানকারী) বুঝাইয়া কইছে, এই টিকা দেলে ক্যানসার অইবে না।’ এ কথাগুলো শাহনাজ বেগমের। বরিশালে ১৪ নভেম্বর বাক্ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী কিশোরী কন্যা আদুরীকে নিয়ে মা শাহনাজ বেগম এসেছিলেন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) বা জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধের টিকা দিতে।
২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকার বাইরে বিনা মূল্যে কিশোরীদের এক ডোজ এইচপিভি টিকা দেওয়া শুরু করেছে সরকার। এই কার্যক্রমের আওতায় স্কুলের বাইরে থাকা কিশোরীদের জন্য অস্থায়ী কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হয়। পেশায় ঝালমুড়ি বিক্রেতা শাহনাজ বেগম এসেছিলেন বরিশাল শহরের রাজ্জাক স্মৃতি কলোনি (কেডিসি) এলাকার চন্দ্রদীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। তিনি জানান, অর্থাভাবে মেয়েকে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত স্কুলে পড়াতে পারেননি।
২০২৩ সালে শুধু ঢাকা বিভাগে প্রথম পর্যায়ের কার্যক্রম চলেছিল। এ বছর বাকি সাতটি বিভাগে স্কুলশিক্ষার্থী ও স্কুলবহির্ভূত কিশোরীদের বিনা মূল্যে এ টিকা দেওয়া হচ্ছে। পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির ছাত্রী এবং স্কুলের বাইরে থাকা ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীরা এই টিকা পাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) পরিচালিত এ কার্যক্রম চলবে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত। গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমুনাইজেশন (গ্যাভি) এইচপিভি টিকা দিয়ে সহায়তা করছে। এ ছাড়া সরকারের এই কার্যক্রমের সঙ্গে রয়েছে ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। বরিশালে ইউনিসেফ বাংলাদেশের সহযোগী হিসেবে মাঠপর্যায়ে টিকাদানের কাজ বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন অব ভলানটারি অ্যাকশনস ফর সোসাইটি (আভাস)।
বরিশালে সাড়ে ৪ লাখ টিকা দেওয়ার লক্ষ্য
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ঢাকা বিভাগে গত বছরের ১৫ অক্টোবর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত ১৫ লাখ ৮ হাজার ১৮৩ জনকে এইচপিভি টিকা দেওয়া হয়। এবার ঢাকার বাইরে মোট ৬২ লাখ ১২ হজার ৫৫৯ কিশোরীকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দেশে বছরে প্রায় ৫ হাজার নারী মারা যান। প্রতিবছর প্রতি লাখে ১১ জন নারী এ ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তবে কিশোরীদের এক ডোজ এইচপিভি টিকা দেওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ঝুঁকি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
টিকা নিয়ে কয়েকজন কিশোরীর অসুস্থ হওয়ার তথ্য ছড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বরিশালের সিভিল সার্জন মারিয়া হাসান বলেন, ‘আমরা কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করেছি। টিকা দেওয়ার পর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঘটনা পাইনি। কিছু জায়গায় কিশোরীরা সকালে খালি পেটে আসায় তাদের শরীরে গ্লুকোজের ঘাটতি ছিল। এ ছাড়া টিকা দিতে একটু ভয় লাগতেই পারে। এসব কারণে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, দুর্বল হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইচপিভি টিকাদানবিষয়ক জেলা স্বাস্থ্য তথ্য সফটওয়্যারের (ডিএইচআইএস) তথ্যমতে, বরিশাল বিভাগে স্কুল ও স্কুলবহির্ভূত মোট ৪ লাখ ৫০ হাজার ৮২৫ জনকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ২১ নভেম্বর পর্যন্ত এ বিভাগে টিকা নিয়েছে মোট ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৭ জন। বরিশাল সিটি করপোরেশনে লক্ষ্যমাত্রার ১৯ হাজার ৮১ জনের মধ্যে টিকার আওতায় এসেছে ১৬ হাজার ২৬ জন কিশোরী। যার মধ্যে স্কুলের শিক্ষার্থী ১১ হাজার ৫৫৩ জন এবং স্কুলের বাইরের ৪ হাজার ৪৭৩ জন।
‘নিজে দেতে পারি নাই’
বরিশাল শহরের একটি টিকাকেন্দ্রে কথা হয় রাহেলা বানুর (আসল নাম নয়) সঙ্গে। তিনিও মেয়েকে টিকা দিতে নিয়ে এসেছেন। যৌন পেশায় জড়িত হওয়ায় এই নারীর জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাঁর মেয়েরও এই পেশায় জড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। রাহেলা বানু জানান, আভাসের স্বেচ্ছাসেবী লাইজু আক্তারের পরামর্শে তিনি টিকাদানকেন্দ্রে এসেছেন। রোগটির ভয়াবহতা এবং টিকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানাতে এলাকার নারীদের নিয়ে উঠান বৈঠক করেছিল ইউনিসেফ ও আভাস।
রাহেলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডরের কোনো কারণ নেই। আমার মামাতো বোন টিকা নেছে। সুস্থই আছে। আমার ছেলের স্কুলেও আলোচনা হুনছি। নিজে তো টিকা দেতে পারি নাই। মাইয়ারে দেওয়ামু না কেন? ওরই তো উপকার অইবে।’
বরিশাল শহরে যৌন পেশায় যুক্তদের টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যে তাঁদের খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তাঁদের খুঁজতে যৌন পেশার সঙ্গে জড়িত ৫ জনকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দায়িত্ব দেয় আভাস। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে কিশোরীদের তালিকা তৈরি করেন। আভাসের তথ্যমতে, স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে, যৌন পেশায় জড়ানোর আশঙ্কা আছে এবং যৌনকর্মী—এমন ৪৪৭ জন কিশোরীকে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। মানতা সম্প্রদায়ের (বেদে) ২৩ জন মেয়েও এই তালিকায় আছে। ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত এ তালিকার মোট ৪১৬ জন কিশোরী এইচপিভি টিকা নিয়েছে।
আভাসের স্বেচ্ছাসেবী লাইজু আক্তার বলেন, ‘যৌনকর্মীদের মধ্যে একটা ধারণা ছিল, এই টিকা হয়তো তাঁদের পেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এসব বিষয়ে বোঝাতে তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতে হয়েছে।’
সচেতনতা বাড়ানো জরুরি
টিকা নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে ইউনিসেফের সহায়তায় সরকার চলতি বছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কৈশোর-বান্ধব স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক প্রশিক্ষণ আয়োজন করেছে। এসব কর্মসূচিতে কৈশোরকালীন পুষ্টি ও পুষ্টিজনিত সমস্যা, বাল্যবিবাহ, কৈশোরকালীন মাতৃত্ব, কৈশোরকালীন পরিবার পরিকল্পনা, যৌনবাহিত ও প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ, কৈশোরে মানসিক স্বাস্থ্য, ঝুঁকিপূর্ণ কিশোর-কিশোরীদের বিশেষ যত্ন, জেন্ডারবৈষম্য, শিশু অধিকার ইত্যাদি বিষয় স্থান পেয়েছে।
এ বিষয়ে বরিশালের সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা সৈয়দ জলিল বলেন, সচেতনতা তৈরিতে শহরের ৩৪টি স্কুলে গিয়ে সরাসরি কিশোরীদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। কোন ওয়েবসাইটে কীভাবে নিবন্ধন করতে হয়, তা দেখানো হয়েছে। কিশোরীরা প্রশ্ন করে টিকা নিয়ে নানা কিছু জেনে নিয়েছে।
টিকা নিবন্ধন আরও সহজ করতে কাজ করেছে তরুণদের কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। স্কুলে বুথ বসিয়ে হাতে-কলমে এই প্রক্রিয়া শেখানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও সহায়তা করেছে ইউনিসেফ।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, ‘এইচপিভি টিকা দিলে জরায়ুমুখ ক্যানসার আক্রান্তের হার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব বলে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের নারীদের সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে ইউনিসেফ। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সব মেয়ের কাছে টিকা পৌঁছাতে চাই আমরা।’