বিদ্যানন্দ নিয়ে সমালোচনা—প্রশ্নের জবাব দিলেন কিশোর কুমার
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিয়ে নানা সমালোচনা চলছে। ফেসবুকে প্রকাশিত একটি কোলাজ ছবি ঘিরে এই সমালোচনা শুরু হয়। এর সূত্র ধরে বিদ্যানন্দের অন্যান্য কাজ এবং প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা নিয়েও ফেসবুকে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন।
আজ সোমবার বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাস তাঁর ফেসবুক পেজ থেকে লাইভ করে এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যাঁরা বিদ্যানন্দকে নিয়ে সমালোচনা করছেন, তাঁরা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই তা করছেন। তাঁরা ভাবছেন, বিদ্যানন্দ ভুল করলে তা দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে বিদ্যানন্দের কাজকর্মে কেউ স্বচ্ছতা না পেলে বা প্রতিষ্ঠানটি অনৈতিক কাজ করছে, এমন মনে করলে যে কেউ বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। এর আগেও বিভিন্নজন উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন, তার জবাবও দেওয়া হয়েছে।
৪ এপ্রিল রাজধানীর বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা ব্যবসায়ীদের সহায়তায় নানা উদ্যোগ নেন। স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্যোগে পুড়ে যাওয়া কাপড়গুলো ব্যবহার উপযোগী করার পর অভিনেতা–অভিনেত্রীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের জনপ্রিয় ব্যক্তিদের কাছে তা বিক্রি করেন। যে কাপড় বাঁচানো সম্ভব হয়েছে, তা দিয়ে শিশুদের পোশাক, গয়নাসহ নানা পণ্য বানিয়ে তা বিক্রি করে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন, এক নারী উদ্যোক্তার বানানো কিছু গয়নার ছবি দেখেই ওই সব গয়না বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে বিদ্যানন্দের ফেসবুক পেজে কোলাজ ছবি প্রকাশের সময় ওই নারী উদ্যোক্তার বানানো কয়েকটি গয়নার ছবিও প্রকাশ করা হয়। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে পরে পেজ থেকে তা সরিয়ে ফেলা হয় এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। তবে এরপরও সমালোচনা চলছে।
ফেসবুক লাইভে কিশোর কুমার দাস এ ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে তিনি এ জন্য দায়ী এবং এ অপরাধে পদ ছাড়তে বললে তাতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিদ্যানন্দের ৮ থেকে ১০টি ফেসবুক পেজ রয়েছে। এতে প্রায় ৩০ হাজার লেখা আছে, তার মধ্যে ৩০টি লেখাতে ভুল থাকতেই পারে। বেতনভুক্ত কেউ লেখাগুলো লিখছেন না, তরুণ স্বেচ্ছাসেবকেরা লিখছেন।
কিশোর কুমার দাস বলেছেন, কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সেখানে কতভাবে কাজ করা যায়, সেটাই বিদ্যানন্দ দেখাতে চেয়েছে। তবে অনেকে অভিযোগ করেছেন, বিদ্যানন্দ বঙ্গবাজারে কাজ করায় পুরো মনোযোগ বিদ্যানন্দের দিকে চলে গেছে। বিদ্যানন্দের জন্যই নাকি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর যে ধরনের প্রতিবাদ হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি।
কিশোর কুমার দাস বলেন, বঙ্গবাজার তহবিলে দুই কোটি টাকা জমা হয়েছে। তা অনুষ্ঠান করেই বিতরণ করা হবে। তবে অনুষ্ঠান কোথায় হবে, তা আগে থেকে কেন জানানো হয় না, তা নিয়েও অনেকে সমালোচনা করছেন। এর উত্তর হলো, আগে থেকে জানানো হলে অনেককেই চাঁদা দিতে হয়। প্রতিষ্ঠান এটি চায় না বলেই আগে থেকে স্থান জানানো হয় না।
বিদ্যানন্দ পাহাড়সহ বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনেছে—এ নিয়ে ফেসবুকে বেশি সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে কিশোর কুমার বলেন, মানুষ বিভিন্ন ভিডিওর অংশবিশেষ দেখে সমালোচনা করছেন। বিদ্যানন্দ বেশির ভাগ জমির মালিক না, লিজ নেওয়া জমিতে অনাথালয়, এতিমখানা, হাসপাতালের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শর্ত অনুযায়ী লিজ নেওয়া হয়েছে জমিগুলো। লিজ দেওয়া জমির দাতা বা প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম বন্ধ করলে জমি ফেরত দিতে হবে। জমি কোনোভাবেই ব্যবসা বা পর্যটনের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালে জমি দাতার কাছে ফেরত চলে যাবে। পাহাড়ে অনাথালয়গুলোতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা থাকছে, স্থানীয় লোকজনই সেখানে কাজ করছেন। তবে স্থায়ী উদ্যোগের জন্য কুড়িগ্রামে মেয়েদের এতিমখানার জন্য এক একরের বেশি জায়গা এবং রামুতে এতিমখানার জন্য জমি কিনেছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন কেন জাকাত নিচ্ছে, তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে কিশোর কুমার দাস বলেছেন, গত বছর বিদ্যানন্দ চেয়েছিল আর জাকাত নেবে না। তখন একজন হুজুর বলেছিলেন, কেউ জাকাত দিতে চাইলে কেন নেবেন না? সে কারণে সিদ্ধান্ত পাল্টানো হয়। এ ছাড়া জাকাত না নিলে আবার প্রশ্ন তুলবেন অনেকে বা অন্য ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হবে। তিনি বলেন, দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া বিদ্যানন্দের মূল তহবিলের মাত্র ৫ শতাংশ আসে জাকাত থেকে।
বিদ্যানন্দের অডিট প্রতিবেদন নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। কিশোর কুমার দাস বলেছেন, যাঁদের মনে প্রশ্ন আছে, তাঁরা একটু কষ্ট করে অডিট ফার্মের কাছ থেকে তথ্য নেন। বিদ্যানন্দ কারও কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে টাকা নেয় না। অডিট ফার্ম ব্যাংক থেকে হিসাব নিয়ে অডিট করে। তাদের বিভিন্ন ভাউচার দিতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী ট্যাক্স, ভ্যাট সব পরিশোধ করা হচ্ছে।
মজিদ চাচা অর্থাৎ একই ব্যক্তিকে বিদ্যানন্দের বিভিন্ন কার্যক্রমে উপকারভোগী হিসেবে প্রচার করা হয়েছে—এ নিয়ে ট্রল হচ্ছে। মজিদ চাচা একটি রূপক বা প্রতীকী চরিত্র, এ কথা উল্লেখ করে কিশোর কুমার দাস বলেন, একবার সত্যিকার একজন উপকারভোগীর নাম প্রকাশ করা হয়েছিল। তবে ওই ব্যক্তির নাম একজন বিখ্যাত লোকের নামের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় তখন বলা হয়েছিল বিদ্যানন্দ ইচ্ছা করেই ওই বিখ্যাত ব্যক্তিকে অপমান করার জন্য কাজটি করেছে। এর পর থেকে শুধু মজিদ চাচা নন, এমন অনেক প্রতীকী নাম প্রচার করা হয়েছে। আর বিদ্যানন্দ নিবন্ধিত এনজিও, নিয়ম অনুযায়ী বিদেশ থেকে টাকা নিতে কোনো সমস্যা তো হওয়ার কথা নয়।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের নাম এবং ব্যক্তি কিশোরের ধর্ম নিয়ে অনেকে অনেক কটূক্তি করছেন উল্লেখ করে কিশোর কুমার দাস বলেন, ‘জন্মগতভাবে হিন্দু পরিবারে আমার জন্ম হয়েছে। আমার ধর্ম নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। মৃত্যু নিয়ে কেউ যাতে কাটাছেঁড়া করতে না পারে, লাশ নিয়ে যাতে কেউ না বলে এটা কোন ধর্মের, তাই বাংলাদেশ থেকে আসার আগে দেহদান করে দিয়ে এসেছি।’
সমালোচনার মুখে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে—এটা নিয়ে ভয় পান না বলে জানিয়েছেন কিশোর কুমার দাস। তিনি বলেন, টাকা না থাকলে স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ করবেন না। তবে বর্তমানে যে সমালোচনা চলছে, তা পরিকল্পনা করেই কোনো গোষ্ঠী করছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেছেন, কারও বিরুদ্ধে বিদ্যানন্দ কিছু বলবে না। দাতব্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে মানুষ বিভিন্ন প্রশ্ন তুলছেন, এটাকে তিনি ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তবে কেউ যেন মিথ্যা তথ্য প্রচার না করেন, সে আহ্বান জানান কিশোর কুমার।
কিশোর কুমার দাস বলেছেন, বড় প্রতিষ্ঠান বলেই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন তদন্তের সম্মুখীন হচ্ছে বিদ্যানন্দ, তাই এটি লাগামছাড়া প্রতিষ্ঠান, তা ভাবলে হবে না। আর দাতাদের আস্থা এমনি এমনি অর্জন করা সম্ভব হয়নি, স্বচ্ছতা আছে বলেই দাতারা আস্থা পান এবং বিপদের দিনেও দাতারা ও স্বেচ্ছাসেবকেরা বিদ্যানন্দকে ছেড়ে যাননি।
বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, দুই বছর আগের ভিডিও দেখে এখন অনেকেই বলছেন, তখনকার কথার সঙ্গে এখনকার কথা মিলছে না। তিনি বলেন, ‘মিলছে না, কারণ তখন হয়তো তা মানতাম এখন আর সেই কথাটি মানি না বা সঠিক মনে করছি না। আগে করপোরেট ডোনেশন নিতাম না, এখন নিচ্ছি। সেলিব্রিটিরা আগে যুক্ত ছিলেন না, এখন যুক্ত করা হচ্ছে। নীতির সঙ্গে মিললেই দাতারা অনুদান দেবেন, না মিললে দেবেন না।’
কারও কোনো প্রশ্ন থাকলে তার উত্তর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হবে জানিয়ে কিশোর কুমার দাস লাইভের সমাপ্তি টেনেছেন। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার প্রকৌশলে স্নাতক করা কিশোর কুমার দাস স্ত্রী জ্যাসিকা মারিয়াকে নিয়ে বর্তমানে লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুতে থাকেন। সেখান থেকেই তিনি লাইভে অংশ নেন।
সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের ১৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও ২টি প্রতিষ্ঠান একুশে পদক ২০২৩ পেয়েছে। এবার সমাজসেবায় এ স্বীকৃতি পেয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু করেছিল ২০১৩ সালে।
একনজরে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন
‘এক টাকায় আহার’ প্রকল্পের আওতায় হাজারো সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, কুড়িগ্রামে এক টাকায় ভাত-ডাল, মাছ-মাংসের রেস্তোরাঁ চালু, ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক কড়াইয়ে একসঙ্গে চার হাজার মানুষের রান্না করার মেগা কিচেন, অবহেলিত উপকূলীয় এলাকা ও চরাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ‘জীবন খেয়া’ নামের ভাসমান হাসপাতাল চালু, বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার পর পরিত্যক্ত পতাকা দিয়ে বাচ্চাদের স্কুলের পোশাক বানানো, ভোটের পর পোস্টার দিয়ে বাচ্চাদের জন্য খাতা বানানো অথবা এবারের বইমেলায় জরাজীর্ণ বইয়ের স্টল দিয়ে মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া যে লাইব্রেরিগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে—এ ধরনের বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে সবার নজর কেড়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু করেছিল ২০১৩ সালে। এ ফাউন্ডেশন প্রতিবছর ১৭ লাখ মানুষকে রান্না করা খাবার খাওয়াচ্ছে। ১ লাখ ২০ হাজার পরিবারকে শুকনা খাবার সহায়তা দিচ্ছে। সাতটি এতিমখানা, পাঁচটি শিখন কেন্দ্র, দুটি স্কুল, একটি হাসপাতাল, দুটি লাইব্রেরি পরিচালনা করছে। এ ফাউন্ডেশন বার্ষিক অনুদান পাচ্ছে ২২ কোটি টাকা। ফাউন্ডেশনের সহায়তার আওতায় নিয়মিত শিক্ষার্থী রয়েছে ১ হাজার ৫০০। এ ফাউন্ডেশনে স্বেচ্ছাসেবক আছে ২০০ জন এবং কর্মকর্তা আছেন ৬০ জন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় শাখা আছে আটটি।
সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশের ১৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও দুটি প্রতিষ্ঠান এ বছর একুশে পদক পেয়েছে। এবার সমাজসেবায় এ স্বীকৃতি পেয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।