আজ বিশ্ব হার্ট দিবস
দেশে ৩৪ শতাংশ মৃত্যু হৃদ্রোগে
জীবনযাপনের ধরন বদলানোই যথেষ্ট নয়। হৃদ্রোগের প্রকোপ কমাতে বায়ুদূষণও কমাতে হবে।
দেশে মৃত্যুর শীর্ষ কারণগুলোর অন্যমত হৃদ্যন্ত্র ও রক্তনালির রোগ বা কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ। একটি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মোট মৃত্যুর ৩৪ শতাংশের পেছনে আছে হৃদ্যন্ত্র ও রক্তনালির রোগ। এত দিন বলা হয়েছে, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য ও কায়িক পরিশ্রমহীন জীবনযাপন হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, বায়ুদূষণ এই রোগের প্রকোপ বাড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা হৃদ্রোগকে বলেন ‘ডেডলি ডিজিজ’। এতে মৃত্যুঝুঁকি বেশি, ঝুঁকি দেখা দেয় আচমকা। প্রায় সূত্রহীনভাবে হঠাৎই ‘হার্ট অ্যাটাকের’ সংবাদ শোনা যায়। দিশেহারা হয়ে পড়ে মানুষ। ঘটনার আকস্মিকতা ছাড়াও হৃদ্রোগ নিয়ে ভয়ের অন্য দিক হচ্ছে, এর চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে হৃদ্রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি, এর প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে এ নিয়ে দেশে গবেষণা হয়েছে কম। কত মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছে, কত মানুষ মারা যাচ্ছে, কত মানুষ ঝুঁকিতে আছে—এসব নিয়ে জাতীয় জরিপ বা গবেষণাভিত্তিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।
গবেষক ও নীতিনির্ধারকেরা নির্ভর করে আছেন সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত সংখ্যার ওপরই। সংক্রামক ব্যাধিবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম এনসিডিপোর্টাল ডট কম বলছে, বাংলাদেশে বছরে যত মৃত্যু হয়, তার ৩৪ শতাংশের জন্য দায়ী হৃদ্যন্ত্র ও রক্তনালির রোগ। সংখ্যার বিচারে ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি।
এই প্রেক্ষাপটে আজ বৃহস্পতিবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব হার্ট দিবস পালিত হতে যাচ্ছে। হার্ট দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্যে প্রত্যেককে হৃদয়বান হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক এস এম মোস্তফা জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছরের প্রতিপাদ্যের অর্থ হচ্ছে সকলে মিলে প্রত্যেকের হৃদয়ের ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে, প্রকৃতির ব্যাপারে হৃদয়বান হতে হবে। হৃৎস্পন্দন চালু রাখতে হবে মানবতার জন্য।’
নতুন উদ্বেগ
হৃদ্রোগ চিকিৎসায় বাংলাদেশ এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ ও কার্ডিয়াক সার্জনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনটি বিষয় ছাড়া বাংলাদেশে হৃদ্রোগ চিকিৎসার জন্য দক্ষ জনবল, আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি দেশে আছে। দেশে এখনো কার্ডিয়াক ট্রান্সপ্লান্ট বা হৃদ্যন্ত্র প্রতিস্থাপন শুরু হয়নি। জন্মগত কিছু জটিল হৃদ্রোগের চিকিৎসাও এখনো দেশের চিকিৎসকদের আয়ত্তে আসেনি। মাংসপেশির দুর্বলতাজনিত হৃদ্রোগের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো চিকিৎসকদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আছে।
হৃদ্রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও রোগটি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। নগরায়ণ, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাদ্যে অভ্যস্ত হওয়া, কায়িক পরিশ্রম কম করা, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না নেওয়া, অত্যধিক মানসিক চাপে থাকা—এসব হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা এতকাল বলে এসেছেন, হৃদ্রোগ ‘লাইফ স্টাইল ডিজিজ’। অর্থাৎ স্বাস্থ্যসম্মত নয় এমন জীবনযাপন পদ্ধতি হৃদ্রোগে ভূমিকা রাখে। এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু জীবনযাপন পদ্ধতি নয়, বায়ুদূষণও হৃদ্রোগের প্রকোপ বাড়াচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের তথ্য বলছে, হৃদ্রোগের মৃত্যুর ২৫ শতাংশের পেছনে আছে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণজনিত হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে সারা বিশ্বে ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
বায়ুদূষণ বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যানুয়েশনের যৌথ প্রতিবেদন ‘এয়ার কোয়ালিটি অ্যান্ড হেলথ ইন সিটিস’–এ বলা হয়েছিল, বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান পঞ্চম।
২০১৯ সালে বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরে ২২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে ২০২০ সালে প্রকাশিত বৈশ্বিক বায়ুদূষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে হৃদ্রোগে যত মানুষ মারা যায়, তার ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী বায়ুতে থাকা অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা (পিএম ২.৫)।
বেশ কয়েক বছর ধরে হৃদ্রোগের কারণ, প্রতিরোধ, প্রতিকার নিয়ে গবেষণা করছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু বড় বড় শহরে দূষণ বেশি, তা নয়।
শহরের আশপাশে ইটের ভাটা দূষণ ছড়াচ্ছে। গ্রামে নারীরা রান্নার সময় ধোয়ার মধ্যে সময় কাটান। হৃদ্রোগের প্রকোপ কমাতে হলে শুধু লাইফস্টাইল পরিবর্তনের কথা বললে হবে না, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও উদ্যোগ নিতে হবে।’