‘ওরে ও নতুন ঈদের চাঁদ/ তোমায় হেরে হৃদয় সাগর আনন্দে উন্মাদ’—কবি কাজী নজরুল ইসলামের গীতিকবিতার এই চরণ দুটি আজ সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। ঈদ কবে হবে, তা সব সময়ই চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে। চাঁদ কবে দেখা যাবে, তা নিয়ে মহাকাশ-বিশেষজ্ঞরা এবার যা বলছেন, তার মানেটা দাঁড়িয়েছে, আজ শুক্রবার আমরা তাকিয়ে রইব পশ্চিমাকাশে। আজ চাঁদ দেখা যেতেও পারে, না-ও পারে।
জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকব আমরা। দেশের কোথাও চাঁদ দেখা গেল কি গেল না, তা নির্ধারণ করে তারা আমাদের জানাবে। তাহলে সংবাদপত্রের পুরোনো শিরোনামটাই আজ প্রযোজ্য, ‘আজ চাঁদ দেখা গেলে কাল ঈদ।’ হিসাবটা বেশ সোজা, আজ চাঁদ দেখা গেলে আগামীকাল শনিবার পবিত্র ঈদুল ফিতর, না হলে পরশু রোববার ঈদ। এরই মধ্যে আমরা জেনে গেছি, সৌদি আরবে ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। সেখানে আজ ঈদ।
২৯ রোজা হলে তো কথাই নেই, ৩০ রোজার শেষেও সন্ধ্যায় যখন বেজে ওঠে ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’, তখন সত্যিই আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় ঘরে ঘরে, অন্তরে অন্তরে।
ঈদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উৎসব। এটা স্পর্শ করে, স্পন্দিত করে দেশের মানুষকে। ঈদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক আয়োজন। জামা-জুতা, পোশাকপরিচ্ছদ, খাবারদাবার থেকে শুরু করে গয়নাগাটি, টিভি-ফ্রিজ, আসবাবের দোকানে পর্যন্ত বিক্রি বেড়ে যায় ঈদকে কেন্দ্র করে। পরিবহন খাতে সবচেয়ে বড় ব্যবসাটা হয় ঈদকে ঘিরেই। ঈদ সংস্কৃতির অঙ্গনেও উদ্যাপনের এক বিশাল উপলক্ষ—টেলিভিশন, ওটিটি, চলচ্চিত্র, সংগীত, সংবাদপত্র—সব মাধ্যমের মানুষেরাই হাজির হন ঈদের বিশেষ পসরা সাজিয়ে।
আমাদের দেশে ঈদের একটা বড় বিশেষত্ব নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা। কোটি মানুষ ছুটে যান তাঁর শৈশবের স্মৃতিধন্য বাড়িতে, গ্রামে, গঞ্জে বা মফস্সল শহরের জন্মভিটায়। প্রবীণ মা-বাবার সঙ্গে বহুদিন পর মিলিত হন বয়স্ক সন্তানেরা, তরুণ সন্তানেরা ফিরে যান মায়ের কাছে। দাদা-দাদি, নানা-নানিরা বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেন নাতি-নাতনিদের। শৈশবের বন্ধুদের কিংবা স্কুল-কলেজের সহপাঠীদের কাছে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি আমরা। কী যে মায়াময় সেই দৃশ্য! মনে মনে গেয়ে উঠি, ‘ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ!’
কাজী নজরুল ইসলামের যে গীতিকবিতাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাতেই আছে:
‘খোদার আদেশ তুমি জান, স্মরণ করাও এসে;
যাকাত দিতে দৌলত সব দরিদ্রেরে হেসে
শত্রুরে আজি ধরিতে বুকে শেখাও ভালবেসে।
তোমায় দেখে টুটে গেছে অসীম প্রেমের বাঁধ॥’
ঈদের নতুন চাঁদ সামর্থ্যবানদের দৌলত বিলিয়ে দেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আহ্বান জানায় শত্রুকে ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে ধরতে। ঈদের চাঁদ যেন অসীম প্রেমের বাঁধ ভেঙে দেয়। যেন প্রীতি, ভালোবাসা, সহমর্মিতা, শান্তির প্লাবন বয়ে যায় দুনিয়াজুড়ে। আমাদের রাজনীতিতে সংঘাতের বদলে যেন আসে সমঝোতা, আমাদের নগর-লোকালয়গুলো বিস্ফোরণোন্মুখ বারুদের স্তূপের বদলে যেন হয়ে ওঠে সুশাসন-সুন্দর নিরাপদ বাসভূমি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অবসান যেন ঘটে, আমাদের আকাশ থেকে সরে যায় শংকার মেঘ। মধ্যপ্রাচ্যসহ সমস্ত পৃথিবীতে বইতে যেন থাকে শান্তির সুবাতাস।
আমাদের সবার ঈদ নিরাপদ হোক। সবাই সুন্দর করে ঈদ করে আবার যে যার নীড়ে ফিরে আসুন। সাম্য-প্রীতিময় একটা বিশ্বের স্বপ্ন আমরা দেখি। ঈদ আমাদের সে স্বপ্নযাত্রাকে গতি দিক, সুন্দর করে তুলুক।