২০২৪ শেষে কী আসবে

২০২৪–এ যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, ২০২৫–এ তা পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন অনেকছবি: প্রথম আলো

২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে, যার ভার আমাদের তাড়িত করবে ভয়াবহ যন্ত্রণা-নিপীড়ন আর জুলাই হত্যাকাণ্ড থেকে উঠে আসা ক্রোধ-ক্ষোভ ও ক্ষত নিয়ে; আবার জ্বলজ্বল করবে আমাদের অভূতপূর্ব লড়াই ও প্রতিরোধের প্রেরণা নিয়ে। তবে সেই জ্বলে ওঠা প্রেরণার পাটাতনে বিভাজনের বীজ জুলাই-উত্তর সময়ে যেভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে, তাতে শঙ্কা জাগে, চব্বিশ শেষ হয়ে পঁচিশ কি আদৌ আসবে? যদি আসে, তবে তার চেহারা কেমন হবে? এর দুই রকম উত্তর হতে পারে—কেমন চাই আর কেমন পাওয়া সম্ভব! যেহেতু ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা নই, কাজেই প্রথম ধরনের উত্তরেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। 

একাত্তরে ধ্বংস আর হত্যার হোলিতে লাখ লাখ প্রাণের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত বিজয়ের ৫৩ বছর পরে দেখি, রাষ্ট্র এ জনযুদ্ধের মূল তাগিদ বা চাহিদাগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সংবিধান যেসব অধিকার বাংলাদেশের নাগরিকদের দিয়েছে, তার সবটা অর্জিত হয়নি। শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ-জাতিসত্তা-লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে বিভেদ দৃশ্যমান। কথা বলার স্বাধীনতা বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার, নারী ও লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষদের অধিকার অর্জিত হয়নি, কৃষক-শ্রমিক-হকারের জীবনমানের উন্নয়ন হয়নি। 

একাত্তর দেখিনি, তবু মুক্তিযুদ্ধের জন-আকাঙ্ক্ষা বাস্তব করতে না পারার উল্লিখিত দুঃখগুলো আমাকে বেদনাহত করে। তবে যখন দেখি চব্বিশের পরও উল্লিখিত প্রতিটি অপ্রাপ্তি রয়েই গেছে, তা আরও বেশি আর্ত করে। যে আন্দোলন শুরুই হয়েছিল বৈষম্যহীনতা ঘোচানোর স্লোগান দিয়ে, সে অভ্যুত্থানের পর দেখি পতিত স্বৈরাচারের দেশি-বিদেশি দোসরদের দাপট, দুর্বল সরকারের ঘাড়ে চেপে বসা এক মেজোরিটারিয়ান সংস্কৃতির চর্চা, দেখি একাত্তরে যারা দেশটাই চায়নি, তাদের কাছ থেকে আজ নিতে হচ্ছে দেশপ্রেমের সনদ। মুক্তিযুদ্ধে যাদের ভূমিকা ছিল গণহত্যায় সহযোগিতা করা, তারা চব্বিশের গণখুনিদের পক্ষে সাফাই গায় আর এক শ্রেণি ‘তৌহিদি জনতা’ নামে দেশটাকে সংখ্যালঘুকৃত ধর্ম, লিঙ্গ, সংস্কৃতির মানুষদের জন্য এক অনিরাপদ জায়গায় রূপান্তরিত করেছে, যা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি দিচ্ছে।    

যে কেউ বলতে পারেন, যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়নি সরকারকে এখনো—কিন্তু যেটুকু সময় আমরা তাদের দেখছি, তাতে কোনো কাজেই তাদের যথেষ্ট স্পষ্ট অবস্থান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের এ দোদুল্যমানতা, জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া কারও কারও মনে প্রতিশোধ ও দখলের তীব্র স্পৃহা আর পতিতদের সময় ঘি-খাওয়া কুলীনদের নতজানু দালালি করে পুনর্বাসিত হওয়ার খায়েস দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। ‘৩৬ জুলাইয়ের’ পর সংস্কারের আয়োজন বাংলাদেশে নতুন আশার সঞ্চার করতে পারে। যদি সংস্কার ঠিকমতো করা যায়, তবে তার আগে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে বন্দোবস্ত করে নেওয়া জরুরি।  না হলে এক দলকে সরানোর পর কেন দেখি অন্য এক বা একাধিক দল একই কাজ করে! দখল-পুনর্দখলের খেলায় জনগণের অধিকার আদায় বা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা আর হয় না।

তাই ২০২৫ সালে দেখতে চাই—প্রথমত, আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে; তাঁদের ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর জীবিকার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার।

দ্বিতীয়ত, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করতে সরকার হরেদরে মামলা না দিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা করার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। কারণ, অযথা মামলা দিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা হয়েছে। হত্যাকারী ও নির্দেশদাতাদের খুঁজে বের করে তাদের শাস্তি দিতে হবে। সেই সঙ্গে যারা পালিয়ে গেছে, তারা কীভাবে দেশের বাইরে গেল, সে বিষয়ে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদেরও শাস্তি দিতে হবে।

তৃতীয়ত, ‘৩৬ জুলাই’–পরবর্তী সব হামলা, ভাঙচুর ও সংঘবদ্ধ সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দেশে জননিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। মাজার, বাউল, ভিন্ন জাতিসত্তা, নারী-হিজড়া, শিশু, ভিন্নধর্মের মানুষদের নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে ঘটা হামলার বিচার এবং ঘটে যাওয়া বৈষম্য দূর করতে হবে। নারীর বিরুদ্ধে অনলাইন সহিংসতা বা সাইবার বুলিং বন্ধ করার জন্য সুরক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের নিবর্তনমূলক ধারা অটুট রেখে করা নতুন আইন বাতিল করতে হবে। এ বিষয়ে তড়িঘড়ি আইন না করে খসড়াটি অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে সংশোধন করতে হবে। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বাড়াতে সংসদে নারী আসন বৃদ্ধি করে প্রথমে শুধু নারীদের জন্য নির্ধারিত আসনে নির্বাচন ও পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। 

চতুর্থত, ফ্যাসিবাদের আমলে যেসব অন্যায়-অবিচার, গুম ও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে (বিডিআর বিদ্রোহ, শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড), যে লুটপাট হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা করতে হবে। আয়নাঘরগুলো
উন্মুক্ত করতে হবে, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

পঞ্চমত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত সংস্কার করে সবার জন্য অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় সরকারি দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। দফায় দফায় শিশুদের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন না করে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের সব শিশুর অনন্ত সম্ভাবনার বিকাশ ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে কেন্দ্রে রেখে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ণ করে তার ভিত্তিতে প্রাক্​প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার ধারণাকে কল্পনা করতে হবে। চাকরি বা ব্যবসার স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যের বদলে দীর্ঘ মেয়াদে মানবিক, সৃজনশীল, অধিকারসচেতন, বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, প্রকৃতি ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ একবিংশ শতাব্দীতে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরিতে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে।

ষষ্ঠত, শ্রমজীবী মানুষের জন্য সেফটি নেট তৈরি করে তাঁদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে কাজ করতে হবে। দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিবারণ না করে, শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা, চিকিৎসাসেবা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না করে এবং সর্বোপরি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম সহনীয় মাত্রায় না কমিয়ে অভ্যুত্থানের সুফল এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ করা শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে না। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিক, যাঁদের রক্তের ওপর দিয়ে আজ শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় রিপাবলিকের স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের ব্যাটারিচালিত রিকশার পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ ডিজাইন সরকারে পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই করবেন—এ আশা রাখি। কেবল গালাগাল না করে এই শ্রমজীবী মানুষদের দলে দলে ঢাকায় অভিবাসন বন্ধে টেকসই উন্নয়নকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বড় শহরের রিকশাচালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে সড়কের আইন মেনে চলার সামাজিক বন্দোবস্ত গড়ে তুলতে হবে। গণপরিবহন বাড়াতে হবে, যাতে কেবল ধাক্কাধাক্কিতে সফল পুরুষদের ‘ব্যাডাগিরি’ নয়, বরং নারী-শিশু-বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের অগ্রাধিকার থাকে। ঢাকাসহ সব মহানগরে সরকারের ব্যবস্থাপনায় বাসমালিকদের একটি বাস্তব, লাভজনক কিন্তু নিরাপদ পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা অসুস্থ না হয়, যানজটের ভয়বহতা দূর করা যায় এবং পরিবেশবান্ধব যান চলাচলে অগ্রাধিকার দেওয়া যায়। বড় শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কনজেশন এবং পার্কিং চার্জ যুক্ত করে দিনের বেলায় গণপরিবহনব্যবস্থাকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এতে পরিবেশদূষণ ও যানজট—উভয়ই কমানো যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত গণপরিবহন লভ্য হতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (বিশেষত নারী ও প্রান্তিক মানুষদের অগ্রাধিকার দিয়ে) জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, সহজ শর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ, বাজারব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার ও ইনোভেশনের সঙ্গে তাঁদের যুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে।

সপ্তমত, কৃষিতে সংস্কার, দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্যনিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তাকে প্রাতিষ্ঠানিক করতে হবে। কৃষকের ওপর নির্ভর করে একটি দেশের প্রাণভোমরা; তা যেন প্রকৃতিকে আরও ধংসের কারখানা না হয়, বড় পুঁজির মুনাফার চাপে পড়ে সাধারণ কৃষক যেন প্রান্তিক না হন, সে কারণে প্রযুক্তি সহজলভ্যকরণসহ কৃষিপণ্যের বিপণনব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। অষ্টমত, ঢাকাসহ বড় বড় শহরে শিল্পকারখানার দূষণ বন্ধের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশকে বিবেচনায় না নিয়ে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া যাবে না। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি-বায়ুদূষণ কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গাছ কাটা বন্ধ করে শহর সবুজায়ন ও জনপরিসর তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে, যেখানে কমিউনিটির সৃজনশীল কাজকে উপস্থাপন করা হবে এবং এসব জনপরিসরকে কেন্দ্র করে নতুন সাংস্কৃতিক পাটাতন তৈরিতে উৎসাহ দিতে হবে। পার্ক, খেলার মাঠ ও জলাশয় দখল-ভরাট বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। মেট্রোরেলের পিলার ও স্টেশন এবং উড়ালসড়কের নিচে পর্যাপ্ত আলো ও সবুজায়নের ব্যবস্থা করে নগরীর ফুসফুস থেকে বিষ দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

শুধু সরকার ও শিক্ষার্থী আন্দোলনকারীরা নয়, জনতার জাগরণকেও সজাগ ও সবাক থাকতে হবে; তবে তা যেন অন্যের অধিকার হরণে পর্যবসিত না হয়, সে খেয়াল রাখতে হবে। সে পর্যন্তই আসলে ব্যক্তির স্বাধীনতার সীমানা। দেশটা সবার জন্য বাসযোগ্য করে যাওয়ার এই অভূতপূর্ব সুযোগকে যেন এ প্রজন্ম হেলায় হারাতে না দেয়, তাদের প্রতি সে শুভকামনাসহ পঁচিশের শুভাগমনের আশায়, পূর্ববর্তী সব ব্যর্থ প্রজন্ম অধীর অপেক্ষায় আছে এবং থাকবে। চব্বিশের সৈনিকদের তাই ব্যর্থ হতে দেওয়া যায় না।   

সামিনা লুৎফা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক; নাট্য সংগঠক