ঈদে পর্যটনে দেড় হাজার কোটি টাকার ব্যবসার আশা, ভয় গরম নিয়ে
সমুদ্র শহর কক্সবাজারের হোটেল ব্যবসায়ী আবুল কাশেম সিকদারের এখন ব্যস্ত সময় কাটছে। হোটেলের কক্ষগুলো পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। দেখা হচ্ছে, এসিগুলো ঠিক আছে কি না। বিদ্যুৎ-সংযোগও পরীক্ষা করা হচ্ছে। এসব বিষয় নিজে থেকে দেখভাল করছেন ডায়মন্ড হোটেলের মালিক আবুল কাশেম। তিনি জানালেন, ঈদের ছুটির সময় তাঁর হোটেলের যত কক্ষ আছে, তার অর্ধেকেই বুক হয়ে গেছে। তাঁর আশা, এবার ব্যবসা ভালোই হবে। তবে এই আশার মধ্যে উঁকি দিচ্ছে ভয়ও। সেই ভয়ের কারণ গরম।
আবুল কাশেম সিকদার বলছিলেন, ‘এবার ছুটি দীর্ঘ। তাই ব্যবসা ভালো হবে আশা করছি। কিন্তু যে গরম পড়েছে, তাতে লোকজন বুকিং দিয়েও আর আসে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় আছি।’
ঈদের পর্যটনে গরমের প্রভাব থাকলেও এবার অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে বলে অনুমান করছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন।
ডায়মন্ড হোটেলে যেসব কক্ষ ভাড়া হয়েছে, এর বেশির ভাগেরই এসি আছে। দেশের পর্যটনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র কক্সবাজারের একাধিক হোটেলে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এসি আছে এমন কক্ষই বেশি বুক হয়েছে। আবুল কাশেম বলছিলেন, এসি নেই এমন কক্ষই বেশি। সেগুলোর চাহিদা কম। এর অর্থ হলো, অপেক্ষাকৃত কম আয়ের মানুষজন এবার তেমন সাড়া দিচ্ছে না। গরমের কথা ভেবেই হয়তো এমনটা হচ্ছে। যদিও এই হোটেল ব্যবসায়ীর কথা, কক্সবাজারের সৈকতে এখন প্রচুর হাওয়া। গরমের ভয়ে যাঁরা আছেন, তাঁদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এখন সমুদ্রও খুব ভালো অবস্থায় আছে।
লম্বা ছুটির মধ্যে ঈদের পর্যটন ব্যবসায় চোখ রাঙাচ্ছে গরম হাওয়া। ৭ এপ্রিল থেকে দেশ বৃষ্টিহীন। ১৭ এপ্রিল পাবনার ঈশ্বরদীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে। এখনো দেশের চার জেলায় তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। আজ শুক্রবার থেকে তাপমাত্রা কিছুটা কমার ইঙ্গিত দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়ার এ পরিস্থিতি থাকলেও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন আশা করছে, এবার ঈদে পর্যটন ব্যবসায় দেড় হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। দেশের বিভিন্ন পর্যটনস্থানের হোটেলগুলোর বুকিং, রিসোর্টগুলোর বুকিং, বিনোদন পার্ক, অভ্যন্তরীণ আকাশপথের যাত্রীদের আসা-যাওয়ার চিত্র, ট্যুর অপারেটর এবং রেস্তোরাঁগুলোর সম্ভাব্য আয়, অন্যান্য পরিবহনের যাতায়াতের চিত্র বিবেচনা করেছে পর্যটন করপোরেশন। এসব বিষয় বিবেচনা করে দেড় হাজার কোটি টাকার হিসাব করা হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (বিপণন ও জনসংযোগ) মো. জিয়াউল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার পবিত্র ঈদুল ফিতর ঘিরে আগের বছরগুলোর চেয়ে বেশি ব্যবসা হবে। কারণ, এবার ছুটিটা দীর্ঘ। করোনার কারণে আগের বছরগুলোতে যে সমস্যা হয়েছে, তা এবার নেই। এসব বিবেচনাতেই আমরা আশা করছি, এবার ব্যবসা ভালো হবে।’
দেশের পর্যটনের পাঁচটি স্থান সবচেয়ে জনপ্রিয় বলে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পর্যটক যান কক্সবাজারে। তারপর আছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, বৃহত্তর সিলেট, বান্দরবান ও রাঙামাটি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর কুয়াকাটার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে বলে জানান জিয়াউল হক।
দেড় শর বেশি হোটেল-মোটেল নিয়ে কুয়াকাটা প্রস্তুত পর্যটকদের জন্য। এসব স্থানে ১৫ হাজারের বেশি পর্যটকের স্থান সংকুলান হয় বলে কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়। ইতিমধ্যে অনেক হোটেলে অর্ধেকের বেশি সিট বুকিং সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ। ঈদের পর থেকে ভিড় বাড়বে বলেই ধারণা তাঁর। তবে তাঁরও চিন্তা গরম নিয়ে।
মোতালেব শরীফ বলছিলেন, ‘সেতু হওয়ার পর কুয়াকাটায় পর্যটক বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এবারও আমরা আশা নিয়ে আছি যে বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসবে। কিন্তু যে গরম পড়েছে, তাতে পর্যটক কম হওয়ার আশঙ্কা আছে। গরম কমলে অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন হবে।’
মোতালেব শরীফ জানান, ১৫ হাজারের বেশি পর্যটকের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকলেও এর আগে এমন অবস্থা হয়েছে যে ৫০ হাজারের বেশি পর্যটক এসেছেন। তখন বিভিন্ন বাসাবাড়িতেও থাকার ব্যবস্থা হয়েছে পর্যটকদের।
প্রস্তুতি যথেষ্ট থাকলেও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনপ্রিয় পর্যটন স্থান শ্রীমঙ্গলের হোটেল বা রিসোর্টে পর্যটকের সাড়া তেমন নেই। ছোট হোটেলগুলোতে বুকিং আছে যথেষ্ট। তবে বড়গুলোতে তেমন বুকিং নেই বলে জানান শ্রীমঙ্গলের পর্যটন সেবা সংস্থার সভাপতি সামছুল হক। তিনি বলছিলেন, ‘গরমের কারণেই বুকিং কম বলে ধারণা করছি। তবে বুকিং না থাকলেও পর্যটকেরা সরাসরি ঈদের পরদিন থেকে আসতে পারেন বলে আমরা আশা করছি।’
রিসোর্টগুলোর ঈদ প্রস্তুতি
জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা রিসোর্টে ঈদের ছুটি কাটাতে যান অনেকেই। এবারের ঈদেও পর্যটকের আশা করছেন এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। দেশের রিসোর্টগুলোর সমিতি ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ট্রিয়াব) প্রেসিডেন্ট খবির উদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, ‘ঈদুল ফিতরকে ঘিরে ভালো ব্যবসার আশা করছি আমরা। এর জন্য প্রতিটি রিসোর্টই নানা প্রস্তুতি নিয়েছে। এখন পর্যন্ত পর্যটকের সাড়াও মন্দ নয়।’
খবির উদ্দিন আহমেদ নড়াইলের অরুণিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাবের চেয়ারম্যান। তাঁর সঙ্গে কথা হয় গতকাল বুধবার। তিনি জানান, ইতিমধ্যে অনেকেই বুকিং দিয়েছেন। মনে হচ্ছে আরও আসবেন। মানুষ গরমকে একটা প্রতিবন্ধকতা মনে করছে। তবে রিসোর্টের পরিবেশ পর্যটকদের জন্য সহায়ক হবে, মনে করেন খবির উদ্দিন।
সাজছে বিনোদনকেন্দ্রগুলো
হোটেল বা রিসোর্টগুলো যেমন ঈদের আগে থেকেই পর্যটক পায়, বিনোদনকেন্দ্রগুলোর ব্যবসায় কিন্তু ঈদের দিন এবং এর পরের দিনগুলোতে জমে ওঠে। কোভিডের কারণে টানা দুই বছর বিনোদনকেন্দ্রগুলোর ব্যবসায় ভালো হয়নি। গত দুই ঈদে তারা কিছু ক্ষতি পুষিয়েছে। এবার তারা আরও বেশি প্রত্যাশা করছে। সে জন্য সাজছে বিনোদনকেন্দ্রগুলো। গত বুধবার নরসিংদীর বিনোদনকেন্দ্র ড্রিম হলিডে পার্কের প্রধান প্রবীর কুমার সাহার সঙ্গে যখন ফোনে কথা হচ্ছিল, তখন আশপাশে ঠুকঠাক শব্দ হচ্ছিল। পুরো রমজান মাসে এই পার্ক বন্ধ ছিল। খুলবে ঈদের দিন। প্রতি ঈদেই নতুন নতুন রাইড শেয়ারিং নিয়ে আসেন বলে জানালেন প্রবীর সাহা। এ বছর স্কাই ট্রেন ও এয়ার বাইসাইকেল নতুন আকর্ষণ। একেবারে অন্তত ২০ হাজার দর্শনার্থী আসার ব্যবস্থা আছে এ পার্কে। তবে ঈদের দিন বা পরের দিন এ সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে যাবে এবার, এমন আশা তাঁর।
এবারের ঈদে পর্যটন স্থানগুলোতে ভিড় আশানুরূপ হবে বলে আশা করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। আর এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে বলে জানান ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি (পরিকল্পনা ও অপারেশন) সরদার নুরুল আমিন। তিনি বলছিলেন, দেশের সবচেয়ে বড় পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারে আগে থেকেই অতিরিক্ত জনবল পাঠানো হয়েছে। দেশের অন্য পর্যটনস্থানগুলোতেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ঈদে পর্যটন ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে। অনেকেই এখন ঈদের ছুটিতে দেশের আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় ঘুরতে যান। দেশের সাত শর বেশি ট্যুর অপারেটর দেশে ব্যবসা করছে। ঈদ পর্যটন অর্থনীতিতেও একটা অবদান রাখছে। তবে কোভিডকাল পর্যটনে বড় ধরনের ক্ষতি করেছিল। কোভিডের আগে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। পরে তা কমে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে এবারের অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ধরে ছুটি পর্যটনে কোভিড-উত্তরকালে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান সন্তোষ কুমার দেব। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের পর্যটন অর্থনীতিতে অবদান রাখতে শুরু করেছে। এবার পর্যটন-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একটা নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে।’
দেশে শীতকালেই মূলত পর্যটন ব্যবসা জমজমাট থাকে। এবার শীতের মৌসুম শেষ হতে না হতেই এসেছে ঈদুল ফিতর। এরপর আসছে ঈদুল আজহা। এটা পর্যটনের জন্য এখন শুভ সংবাদ বলে মনে করেন অধ্যাপক সন্তোষ কুমার দেব। তবে তিনি মনে করেন, এবার ঈদের ছুটি দীর্ঘ হলেও গরম এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে পর্যটকদের ভ্রমণের সময় অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত হতে পারে।