ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্যে গরমিল
গতকাল এক দিনে আরও ৮ জনের মৃত্যু। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১১৪।
ডেঙ্গুতে মৃত্যু নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যে গরমিল দেখা যাচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যানে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখানো হচ্ছে। আবার কোথাও মৃত্যু বেশি দেখা যাচ্ছে। একইভাবে আক্রান্তের সংখ্যাও কম পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানী ও চট্টগ্রামের চারটি বড় সরকারি হাসপাতালের তথ্য যাচাই করে এটা জানা গেছে।
এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। সঙ্গে মৃত্যুও বাড়ছে। গতকাল সোমবার এক দিনে আরও ৮ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১১৪। এর মধ্যে ৬৬ জন নারী এবং ৪৮ জন পুরুষ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর বিস্তার মোকাবিলা করতে হলে সঠিক তথ্য দরকার। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যে গরমিল দেখা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম প্রতিদিন রাজধানীর ২০টি সরকারি হাসপাতাল, ৪২টি বেসরকারি হাসপাতাল এবং ঢাকা শহরের বাইরের ৭১টি হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর তথ্য প্রকাশ করে। গতকাল প্রথম আলো মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহ করেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের প্রকাশ করা তথ্যের মিল নেই।
প্রতিদিন ওই হাসপাতালগুলো নির্দিষ্ট ছকে কন্ট্রোল রুমে ডেঙ্গুর তথ্য পাঠায়। ওই ছকে অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টায় নতুন কত রোগী ভর্তি হলো, কতজনের মৃত্যু হলো, কত রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলেন এবং কত রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সেই তথ্য থাকে। কন্ট্রোল রুম সব হাসপাতালের তথ্য একত্র করে তা সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও গণমাধ্যমে পাঠায়।
তথ্য হতে হবে অবাধ। সবার কাছে পূর্ণাঙ্গ তথ্য থাকতে হবে। তা না হলে আপনি ঠিকভাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবেন না।
হাসপাতালের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে কন্ট্রোল রুমের তথ্যের পার্থক্য সম্পর্কে জানতে চাইলে গতকাল রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তথ্যে গরমিল হওয়ার কথা না। যদি হয়ে থাকে তা হলে অবশ্যই তা দূর করা হবে। আমি আগামীকালই (আজ মঙ্গলবার) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।’
মৃত্যুর তথ্যে গরমিল
গতকাল মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান প্রথম আলোকে যে তালিকা দেন, তাতে দেখা যায়, জুন মাসে ওই হাসপাতালে ডেঙ্গুতে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর জুলাই মাসে গতকাল পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। কোন তারিখে এসব মৃত্যু হয়েছে, তালিকায় তা উল্লেখ আছে। এর আগে ওই হাসপাতালে জানুয়ারিতে একজনের মৃত্যু হয়েছিল। সব মিলিয়ে মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো তথ্যে বলা হয়েছে, মুগদা হাসপাতালে মারা গেছেন ২৫ জন। অর্থাৎ কন্ট্রোল রুমের তালিকায় পাঁচজনের মৃত্যুর হিসাব নেই।
একই ধরনের ঘটনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয় থেকে প্রথম আলোকে দেওয়া তথ্যে বলা হয়েছে, হাসপাতালটিতে এ বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৩ জন।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো তথ্যে দেখা যায়, এ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২০ জন। অর্থাৎ কন্ট্রোল রুমের হিসাবে তিনজনের মৃত্যুর তথ্য নেই।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, ওই হাসপাতালে এ পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। কন্ট্রোল রুম বেশ কয়েক দিন ধরে বলে আসছে, হাসপাতালটিতে ১১ জন মারা গেছেন।
কক্সবাজার জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয় প্রথম আলোকে জানিয়েছে, ওই জেলায় এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে চারজন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। রোহিঙ্গাদের আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য কন্ট্রোল রুম প্রকাশ করে না।
ভর্তির তথ্যে গরমিল
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্র্রোল রুম বলেছে, ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ২২ হাজার ৪৬৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কোন হাসপাতালে কত রোগী ভর্তি হয়েছেন, তার তথ্যও আলাদাভাবে দেওয়া হয়েছে।
কন্ট্রোল রুম বলছে, ঢাকা মেডিকেলে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৪৯২ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ওই হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয় বলছে, রোগী ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৫১৭ জন। কন্ট্রোল রুমের হিসাবে রোগী কম দেখানো হয়েছে।
কন্ট্রোল রুমের হিসাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩৫৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। প্রথম আলোকে ওই হাসপাতালের পরিচালকের দেওয়া তথ্য বলছে, ওই হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছেন আরও বেশি, মোট ১ হাজার ৪৪৫ জন।
ডেঙ্গু রোগী এ বছর সবচেয়ে বেশি ভর্তি হচ্ছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত জুন মাসে এবং এ মাসে গতকাল পর্যন্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন ৪ হাজার ৩৫ জন। তবে কন্ট্রোল রুম বলছে, ১ জানুয়ারি থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত ওই হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছেন মোট ৩ হাজার ৯৬৪ জন। অর্থাৎ প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে ভর্তি রোগী অনেক কম।
মৃত্যু ও ভর্তি রোগীর সংখ্যায় গরমিল হওয়া ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তথ্য হতে হবে অবাধ। সবার কাছে পূর্ণাঙ্গ তথ্য থাকতে হবে। তা না হলে আপনি ঠিকভাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবেন না।’