চট্টগ্রাম ওয়াসা
বছরে ‘সিস্টেম লসের’ ক্ষতি শতকোটি টাকা
অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে পানি চুরি ও কিছু মিটার পরিদর্শকের কারসাজির কারণে সিস্টেম লস কমছে না।
প্রতিদিন নষ্ট হয় সাড়ে ১৪ কোটি লিটার পানি। বছরে ক্ষতি অন্তত ১৪২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
আবাসিক গ্রাহক সংযোগ আছে ৭৮ হাজার ৫৪২টি এবং বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি।
চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি উৎপাদন করে, তার প্রায় ৩০ ভাগ ‘সিস্টেম লস’ (কারিগরি অপচয়) হিসেবে দেখানো হয়।
অর্থাৎ কাগজে–কলমে প্রতিদিন ওয়াসার গড় উৎপাদন ৪৮ কোটি লিটার হলেও গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করে সাড়ে ৩৩ কোটি লিটার। বাকি সাড়ে ১৪ কোটি লিটার নষ্ট হচ্ছে। এই নষ্ট পানির জন্য সংস্থাটির বছরে ক্ষতি অন্তত ১৪২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
ওয়াসার প্রকৌশলী ও রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ বছর ধরেই ৩০ শতাংশ হারে সিস্টেম লস হচ্ছে। সিস্টেম লসের বড় কারণ অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে পানি চুরি এবং কিছু মিটার পরিদর্শকের কারসাজি। প্রকৃত সিস্টেম লস ৫ শতাংশের বেশি নয়, যা হয় পুরোনো লাইন ও ছিদ্রের কারণে।
ওয়াসার বোর্ড সভায় ‘সিস্টেম লস’ ও পানি ‘চুরি’ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কথা উঠেছে। প্রায় প্রতি বোর্ড সভাতেই ওয়াসার পক্ষ থেকে সিস্টেম লস কমিয়ে আনার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আর পূরণ করা হয় না। চুরি ও মিটার পরিদর্শকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহ নিজেও অবগত আছেন। কিন্তু কখনো কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত করতে কার্যকর পদক্ষেপও নেননি। ওয়াসার খাতায়ও এটি ‘নন রেভিনিউ ওয়াটার’।
ওয়াসার উৎপাদন চিত্র অনুযায়ী, একটি শোধানাগারের উৎপাদনের সমান পানি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার ব্যাখ্যা এ রকম—শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার ১ ও ২ থেকে আসে ১৪ কোটি করে ২৮ কোটি লিটার, শেখ রাসেল পানি শোধনাগার থেকে ৯ কোটি লিটার ও মোহরা পানি শোধনাগার থেকে আসে ৯ কোটি লিটার। এ ছাড়া গভীর নলকূপ থেকে আসে ৪ কোটি লিটার পানি। আর সাড়ে ১৪ কোটি লিটার পানি থাকছে না সিস্টেম লসের নামে।
ওয়াসা সূত্র জানায়, এক ইউনিট বা এক হাজার লিটার পানি উৎপাদন করতে খরচ হয় ২৭ টাকা। সে হিসাবে সাড়ে ১৪ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করতে প্রতিদিন খরচ হয় ৩৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা। পুরো টাকাই গচ্চা দিতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। প্রতিষ্ঠান চালুর শুরু থেকেই সিস্টেম লসের এই ক্ষতি ছিল। শুরুতে এটি ৪০ শতাংশ হলেও ধাপে ধাপে কমে এসেছে। তবে ৩০ শতাংশের নিচে নামেনি। ওয়াসার ওয়েবসাইটে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা তথ্য (এমআইএস) প্রতিবেদন দেওয়া আছে। ওই বছরের এপ্রিলেও সিস্টেম লস ছিল ৩০ শতাংশ।
চুরি, অবৈধ সংযোগ ও মিটার পরিদর্শকদের কারসাজির কারণে সিস্টেম লস বেশি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ। তিনি বলেন, ছিদ্রের কারণে খুব বেশি পানি নষ্ট হয় না। অবৈধ সংযোগ ও রাস্তার কলে পানির অপচয়ে ক্ষতি বেশি হচ্ছে। সিস্টেম লস কমিয়ে আনার জন্য কাজ করছে ওয়াসা।
এ কে এম ফজলুল্লাহ জানান, পানির মিটার ডিজিটাল করা হচ্ছে। মিটার পরিদর্শকদের ভবিষ্যতে আর দুয়ারে দুয়ারে যেতে হবে না। গ্রাহকই মিটারের বিষয়ে জানাতে পারবেন। ভবিষ্যতে সিস্টেম লস এক ডিজিটে চলে আসবে।
১৯৬৩ সালে যাত্রা শুরু করা ওয়াসার বর্তমান আবাসিক গ্রাহক সংযোগ আছে ৭৮ হাজার ৫৪২টি এবং বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি। নগরের প্রায় ১৬৮ দশমিক ২১ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সাড়ে ৭০০ কিলোমিটার লাইনে পানি সরবরাহ করা হয়। সংস্থাটির ৭০ শতাংশ লাইন এখনো পুরোনো।
ক্ষতি কমে না, দাম বাড়ে পানির
ক্ষতি না কমালেও ঠিকই বছর বছর পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৩ বছরে পানির দাম বেড়েছে ১২ বার। মাঝে গত বছর করোনা মহামারির কারণে পানির দাম বাড়ানো হয়নি।
কিন্তু সম্প্রতি আবাসিকে পানির দাম একলাফে ৩৮ শতাংশ ও বাণিজ্যিকে ১৬ শতাংশ বাড়িয়ে আবার আলোচনায় এসেছে সংস্থাটি। প্রতি ইউনিটের জন্য আবাসিক গ্রাহকের পানির দাম ১৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা এবং বাণিজ্যিকে ৩১ টাকা ৮২ পয়সা থেকে ৩৭ টাকা করা হয়েছে।
পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের দাবি, বিভিন্ন প্রকল্পে ওয়াসা ঋণ করেছে। পাশাপাশি পানির উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। এ কারণে পানির দাম বাড়াতে হয়েছে।
সিস্টেম লসের ৯০ শতাংশই পানি চুরির কারণে হয় বলে মন্তব্য করেছেন সনাক–টিআইবির চট্টগ্রামের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী। তিনি বলেন, পানি চুরির সঙ্গে ওয়াসার অনেকে জড়িত। এ কারণে এ ক্ষতি কমে না। সিস্টেম লসের নামে পানি চুরি বন্ধ করলে একলাফে এত টাকা বাড়াতে হতো না।