ব-য়ে ব্রুটাস: আগস্টের আবছায়া তত আবছায়া নয়
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা আমার উপন্যাস আগস্ট আবছায়া আসলে শুরু হয়েছিল অনেকগুলো ব-য়ের চক্করে পড়ে। ব-তে বিশ্বাসঘাতকতা, ব-তে ব্রুটাস, ব-তে বিভীষিকা; আবার ব-তেই এগুলোর শিকার বঙ্গবন্ধু।
এখনো মনে আছে, তিন বছরের দীর্ঘ পড়াশোনা শেষে যখন উপন্যাসটা লেখা শুরু করি, তখনো আমি নিশ্চিত যে জুলিয়াস সিজারের হত্যাকারী ব্রুটাসকে দিয়েই এর আরম্ভটা হবে। আর ওভাবে ব্রুটাস হয়ে, খন্দকার মোশতাক-ফারুক-রশিদ ঘুরে আমি হাজির হব আগস্টের সেই আবছায়ায়, আলো-আঁধারির ভোররাতে।
জুলিয়াস সিজারকে ব্রুটাসের বাহিনী ছোরার ২৮টা (মতান্তরে ২৩) আঘাতে হত্যা করেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ তারিখে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের তারিখও ওই ১৫-১৫ আগস্ট। মৃত্যুর সময়ে সিজারের বয়স ছিল ৫৫, আর বঙ্গবন্ধুরও ঠিক তাই-৫৫। রোমান রিপাবলিককে শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যের দিকে যাত্রা করিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রনেতা সিজারের মৃতদেহ রোমের সিনেট হাউসের সিঁড়ির ওপরে নিঃসঙ্গ পড়ে ছিল বহু বহু ঘণ্টা। আর বাংলাদেশ নামের নতুন জাতিরাষ্ট্রের জন্মদাতা নেতার মৃতদেহ তাঁর বাড়ির সিঁড়িতে বা মেঝেতে পড়ে ছিল ২৪ ঘণ্টার বেশি সময়।
দুজনের মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তের কথাবার্তার মধ্যেও কী রকম মিল। সিজার তাঁর আসনে বসলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা সিমবার নামের এক সিনেটরের ভাইকে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে আনার দাবি অসভ্যের মতো হইচই করে জানাতে জানাতে সিজারকে ঘিরে ধরল। সিজার হাত তুলে তাদের সরতে বললেন। কিন্তু সিমবার সিজারের গায়ের কাপড়-টোগা বলে সেটাকে-ধরে টান দিল। সিজার সিমবারের উদ্দেশে চিৎকার করে বললেন, ‘আরে, এ কেমন বর্বরতা। আমি জুলিয়াস সিজার, তোদের নেতা।’ এরপরই কাসকা বের করল ড্যাগার, কোপ মারল সিজারের ঘাড়ে। সিজার কাসকাকে ধরে ফেললেন। চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘কাসকা, শয়তান, কী করছিস তুই? এতটা আস্পর্ধা? সিজারকে কেউ মারতে পারে?’ কাসকা সিজারের ধমক খেয়ে ভয়ে পিছিয়ে গেল। সে ঘাবড়ে গিয়ে বাকি বিশ্বাসঘাতকদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল, ‘ভাইয়েরা, হেল্প! হেল্প!’ ওই কাসকার নামেই নাম আরেক কাসকা (‘কাসকা’ নামের তিনজন ব্যস্ত ছিল সেদিন সিজারকে মারতে, যেমন ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে ছিল মোট তিন ‘মহিউদ্দিন বা মুহিউদ্দিন’) ততক্ষণে সিজারের পাঁজরে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে। এরপর সব দিক থেকে মুহুর্মুহু ছোরার আঘাত-ক্যাসিয়াস সিজারের মুখে, বুসিলানুস পিঠে, ডেসিমাস ঊরুতে। সিজার পড়ে গেলেন দহলিজের সিঁড়ির ওপর। তাঁর গায়ের টোগা ভেসে যাচ্ছে রক্তে। প্লুটার্কের ভাষায়, ‘বন্যার মতো রক্ত নামল সিনেট হাউসের সিঁড়িতে’।
এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো দেখুন। আমি আমার উপন্যাস থেকেই তুলে ধরছি: ‘বঙ্গবন্ধু এখন তাঁর বেডরুমে। হুদা হাতে নিল তাঁর এরিনমোর তামাকের কৌটা ও পাশে রাখা দেশলাই বাক্স। বেডরুমে মাত্র তিনজন। বঙ্গবন্ধু, হুদা ও মুহিউদ্দিন। হুদা বলল, “সরি, টেলিফোন করতে পারবেন না। চলেন।” তাঁরা তিনজন কামরা থেকে বের হলেন। বঙ্গবন্ধু “কামাল, কামাল” বলছেন এবং মাথা নাড়ছেন ডানে-বামে। আমি এক মুহূর্তের জন্য ভাবলাম, তিনি কি তাঁর সদ্য মৃত বড় ছেলের জন্য কাঁদছেন নাকি? সিঁড়ি বারান্দার মুখে তারা এবার। বঙ্গবন্ধু সামনে, হুদা একটু পেছনে তাঁর বাম পাশে। হুদার পেছনে মুহিউদ্দিন, তার পাশে ও পেছনে তিনজন সেপাই, তাদের অস্ত্র যার যার হাতে। বঙ্গবন্ধুকে শুনলাম কাকে যেন বলছেন, “বেয়াদবি করছিস কেন? আমি তোদের জাতির পিতা।” নূর মাঝখানের ল্যান্ডিং থেকে হাত তুলে বুড়ো আঙুলে চুটকি বাজিয়ে হুদাকে একটা ইঙ্গিত দিল। একঝলক। হুদা ঝট করে বঙ্গবন্ধুকে টপকে নিচে নেমে গেল, নূরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বঙ্গবন্ধু কেমন সচকিত হয়ে উঠলেন। নূর চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘স্টপ। স্টেপ অ্যাসাইড।’ বঙ্গবন্ধুর একেবারে পেছনে তখন দাঁড়িয়ে মেজর মুহিউদ্দিন, যে কিনা একটু আগে এই প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষটার ধমক খেয়ে গুলি চালানোর কথা ভুলে গিয়েছিল। সে এবং তিন সৈনিক মুহূর্তের মধ্যে সিঁড়িবারান্দা থেকে তিনতলায় ওঠার দিকটায় সরে গেল। নূর পাগলের মতো চিৎকার করছে, “স্টপ দেয়ার, স্টপ।” নূর হঠাৎ কনুই দিয়ে গুঁতো দিল হুদাকে। নূরের ও হুদার স্টেনগান বঙ্গবন্ধুর বুকের সোজা উঠল। নূর বলল, “ফ্রিজ।” তারপরই গুলি। ব্রাশফায়ার। মোসলেম আর সারওয়ারও ফায়ার করল। একঝাঁক গুলি। ওরা নির্বিঘ্নে বিশ্বস্ত হুকুমবরদারের মতো গিয়ে বিঁধল বঙ্গবন্ধুর বুকের ডান দিকে, আর সেখানে এক বিশাল ছিদ্র করে ওদের কেউ কেউ বেরিয়ে গেল তাঁর পিঠ দিয়ে। গুলির ধাক্কায় তিনি মুখ থুবড়ে, হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সিঁড়ির ওপরে। সেখানে দু-তিন ধাপ নেমে এবার স্থির হলো তাঁর উপুড় হওয়া শরীর, তখনো এক হাতে দেশলাই ও পাইপ। মোট ২৮টা গুলি। আমি ভালো করে তাকালাম তাঁর কেঁপে কেঁপে স্থির হতে থাকা দেহটার দিকে। এখনো নড়ছে সেটা। সামান্য, ক্ষীণ সে কাঁপছে বিদ্যুতায়িত হলে শরীর যেমন কাঁপে, তেমনভাবে। এইবার শুরু হলো তাঁর পাঞ্জাবির রক্তে ভিজে ওঠা। প্রথমে ধীরে, তারপর বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো।’
আমি ভাবি, মার্ক অ্যান্টনি যদি সিনেট ভবনে সেদিন ঢুকতে পারতেন, তাহলে ইতিহাস অন্য রকম হতো। তিনি সিজারের সঙ্গেই দালানটার ভেতরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকদের দুজন-ট্রেবনিয়াস ও ডেসিমাস ব্রুটাস (আসল লোক মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস নয়) সিজারের চোখের আড়ালেই অ্যান্টনিকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দিল, তাকে আটকে রাখল বাইরে। ঠিক তেমন আমার বিশ্বাস যে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে ছুটে যাওয়া কর্নেল জামিলউদ্দিন আহমেদ যদি সে রাতে সোবহানবাগ মসজিদের ওখানে শুরুতেই মারা না পড়তেন, যদি তিনি কোনোমতে ৩২ নম্বরের বাড়িতে পৌঁছুতে পারতেন, তো ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতো। আমার এই অনুমান এক টেকনিক্যাল সামরিক হিসাবের অংশ। সে আরেক গল্প, যা বিস্তারিত করবার জায়গা এটা নয়।
এত মিলের পরেও এ দুই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আবার ওই ‘ব’ অক্ষর ঘিরেই। সিজার তাঁর দেহে ছোরা চালানো ওই খুনিদের মাঝখানে হঠাৎ দেখলেন তাঁর পালিত পুত্র (মতান্তরে তাঁর নিজেরই ঔরসে জন্ম নেওয়া) ব্রুটাসকে। তিনি ব্রুটাসকে দেখে ব্রুটাসের ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতায় লজ্জা পেয়ে গায়ের টোগা দিয়ে মাথা ঢাকলেন, আর বললেন, ‘কাই সু, টেকনন?’ ‘তুমিও, পিচ্চি?’ শেক্সপিয়ার এ বাক্যটাকেই তাঁর নাটকে অমর করে রেখেছেন আরেক বাক্য দিয়ে: ‘তুমিও, ব্রুটাস?’ ভাষাবিদদের বহু গবেষণার শেষে এখন বলা হয়, ওই ‘কাই সু, টেকনন’ কথার আসল মানে: ‘দোজখে দেখা হবে, পাঙ্কু ছোকরা।’ পুত্রের হাতে খুন হতে থাকা কোনো পিতা নিয়তির কাছে নিজেকে শেষ সমর্পণের মুহূর্তে তাঁর বেইমান পুত্রকে এমন হেঁয়ালিভরা কিছুই বলবেন হয়তো।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি ব্রুটাস খন্দকার মোশতাক আহমদকে বলে যেতে পারেননি ও রকম কোনো কথা। কারণ, মোশতাক ব্রুটাসের চাইতে বেশি ধড়িবাজ ছিলেন। তিনি পুরান ঢাকার আগা মসিহ লেনে বসে শয়তানের উদ্দেশে (মহান স্রষ্টার উদ্দেশে নয়) তখন প্রার্থনা করছিলেন খুনটা যেন ভালোভাবে সম্পন্ন হয়। আসলে ধানমন্ডির ওই বাড়িতে আসবার নৈতিক ও মানসিক সাহসটুকুও ছিল না আমাদের এই বয়স্ক পাঙ্কের।
আমি উপন্যাসটার প্রথম খসড়া পর্যন্ত দৃঢ়সংকল্প ছিলাম যে আমার কল্পনায় বঙ্গবন্ধু গুলিবিদ্ধ হয়ে সিঁড়িতে পড়ে যেতে যেতে বলবেন, ‘তুমিও, মোশতাক!’ কারণ, তিনি হঠাৎ দেখবেন তাঁর দীর্ঘদিনের সহচর, তাঁর বাসায় সকাল-বিকেল খেতে আসা, গল্প করতে আসা, তাঁর সন্তানদের প্রতি আপন চাচার মতো স্নেহ দেখানো মোশতাক ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িঘরের তিনতলা থেকে মাথাটা চোরের মতো বাইরে বের করে হাত বাড়িয়ে চেষ্টা করছে নিচে দাঁড়ানো মেজর মুহিউদ্দিনের মাথায় চাটি মারতে। তিনি দেখবেন মোশতাক মুহিউদ্দিনকে বলছেন, ‘শালা মুহিউদ্দিন, তুই ধমক খেয়ে গুলি চালাতে পারলি না বলেই তো উনি অতগুলো কথা বলে যেতে পারলেন।’ কী কথা?
ফরিদপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা ওই সাধারণ মানুষটা এতই সরল-সাধারণ ছিলেন যে মৃত্যুর আগমুহূর্তেও তাঁর ভুল (কিংবা সঠিক) এক দৃঢ় বিশ্বাস থেকে তিনি চিৎকার করে বলে যেতে পেরেছিলেন, ‘কী? তোদের এত সাহস? পাকিস্তান আর্মি আমারে মারতে পারে নাই। আমি বাঙালি জাতিরে ভালোবাসি। বাঙালি আমারে ভালোবাসে। আমাকে কেউ মারতে পারে না। তোরা আমারে মারতে পারিস না। তোরা এই সব করিস না। তোরা ভদ্রলোকের বেডরুমে ঢুকে গেছিস ভোররাতে?’
এ কথা পৃথিবীর সহিংস ও বিশ্বাসঘাতক চরিত্রকে অস্বীকার করা এবং এর সৌন্দর্যের সামনে মাথা নত করা এক বিশ্বাসী মানুষের কথা। উপন্যাসের খসড়া পরিকল্পনায় ছিল, বঙ্গবন্ধুর এই আত্মবিশ্বাসী বাক্যের সামনে থমকে গিয়ে প্রথম দফায় মেজর মুহিউদ্দিনের পিছিয়ে আসাটা মোশতাককে বিবেক ও বিবেকহীনতার ধূম্রজালে ফেলে দেবে, আর তাই তিনি বিরক্ত হয়ে মুহিউদ্দিনের মাথায় চাটি মারতে যাবেন এবং তখনই বঙ্গবন্ধু তাকে দেখে ফেলে বলে উঠবেন, ‘তুমিও, মোশতাক!’
আমার পরিকল্পনা এমন ছিল যে লেখার শুরুতেই এভাবে বঙ্গবন্ধু পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন জুলিয়াস সিজারের হত্যাদৃশ্যের। সিজার হত্যাকাণ্ডের ক্লাইমেক্স পয়েন্ট এই ‘তুমিও, ব্রুটাস!’ চিৎকারটুকুর পুনরাবৃত্তি বিশ্বসাহিত্যে যে কবার ঘটানো হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয়টা হোসে সারামাগো কিংবা টমাস বার্নহার্ডের হাতে ঘটেনি। সেটা ঘটিয়েছেন আর্জেন্টাইন লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেস। তিনি তাঁর অতি ছোটগল্প ‘দ্য প্লট’-এ লিখে গেছেন যে আর্জেন্টিনার বুয়েনেস এইরেস প্রদেশের দক্ষিণে এক কাউবয়কে একদিন খুন করার জন্য ঘিরে ধরল একদল বিশ্বাসঘাতক। ওই লোকটা যখন আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, সে দেখল খুনিদের দলে আছে তার নিজের পালিত পুত্রও। তখন সে ভর্ৎসনা ও বিস্ময় জানিয়ে তার পুত্রকে বলল, ‘আরে, তুইও এখানে?’ বোর্হেস এরপর গল্পের শেষ লাইনে লিখেছেন, ‘মারা গেল সে। কিন্তু সে জানে না যে তার এই মৃত্যুটা ঘটল কেবল ইতিহাসের একটা দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর স্বার্থেই।’ আমার উপন্যাসে বাংলা অনুবাদে রয়েছে বোর্হেসের এই গল্প, যেটার কথা ছিল একদম শুরুতে থাকার।
কিন্তু না। শুরুতে আসেনি ব্রুটাস, শুরুতে আসেনি জুলিয়াস সিজারের হত্যাকাণ্ড। ওগুলোতে সমস্যা দেখা দিল। কারণ, ওগুলো সুনির্দিষ্ট, স্পেসিফিক। আর বাস্তবে সহিংস পৃথিবীর ইতিহাসের আসল রক্তাক্ত চেহারাটা ব্যক্তিনাম নিরপেক্ষ, শাশ্বত। সে এক প্রাকৃতিক ঝড়, সে এক গোঁ-গোঁ দুলতে থাকা ব্র্যান্ড-নামহীন পেন্ডুলাম। বর্বরতার সেই ইতিহাস জাতে অপরিবর্তনীয়, যা কিনা ‘পুনরাবৃত্তি, রূপের ভেদ ও সিমেট্রিকে পছন্দ করে।’
পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করবার মুহূর্তে আমার মনে হলো—সত্যিকারের পুনরাবৃত্তি সেটাই, যেখানে সিজারের কথা বলা নেই, ব্রুটাসের নাম বলা নেই, কারও নাম ধরেই আসা নেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের চৌহদ্দিতে। মনে হলো, ইতিহাস মানুষের নাম–নিরপেক্ষ নয় অবশ্যই, কিন্তু শত শত কোটি মানুষের ইতিহাসকে কল্পনায় অনেক দূর থেকে দেখার চেষ্টা করলে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট যে ওই এক ১৫ আগস্ট তারিখে বিশ্ব ইতিহাসে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ৯ কোটির ওপরে মানুষের বর্বর হত্যাকাণ্ড-সংখ্যাটা ৯ কোটি ছাড়াল বলেই তার শাঁসে গিয়ে নামহীন।
তাই আমি আগস্ট আবছায়ার শুরুতে জুলিয়াস সিজার ও ব্রুটাসকে বাদ দিয়ে শেষমেশ থাকলাম ফ্রানৎস কাফকার কলমে এক নামহীন সম্রাটের গল্প বলায়—কোনো এক অনামা দেশের এক ‘অনির্দিষ্ট’ জাতির পিতার নৃশংস খুনের গল্প সেটা। আমার উপন্যাসের দ্বিতীয় পৃষ্ঠাতেই আছে কাফকার গল্পটার চুম্বক অংশ: ‘সম্রাটের চারপাশে সারাক্ষণ থিকথিক করছে মেধাবী কিন্তু শয়তানিতে ভরা রাজন্যের দল। চাকর ও বন্ধুর বেশ ধরে তারা তাদের বদমায়েশি ও শত্রুতাকে ঢেকে রেখেছে। সম্রাটের ক্ষমতার বিপরীতমুখী শক্তি তারা, বিরামহীন চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের বিষমাখা তির দিয়ে কীভাবে সম্রাটকে আসন থেকে সরানো যায়।...এই সব সংগ্রাম ও যাতনার কথা সাধারণ মানুষ কোনো দিন জানতে পারে না। তারা দেরিতে আসা লোকদের মতো, কোনো শহরে ঢোকা আগন্তুকদের মতো, লোক গিজগিজ গলিপথগুলোর শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ চিবুতে থাকে দেশের বাড়ি থেকে আনা তাদের খাদ্যখাবার, যখন কিনা তাদের সামনের দিকে, দূরে, শহরের মাঝখানের মার্কেট স্কয়ারে এগিয়ে চলে তাদের নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর কাজ।’
বঙ্গবন্ধুকেও হত্যা করেছিল ‘চাকর ও বন্ধুর বেশ ধরে থাকা’ তাঁর কাছের লোকেরাই। সবাই, সব মানুষই, কাছের লোক ছিল তাঁর। আমার তিন-সাড়ে তিন বছরের পড়াশোনায় দুটো জিনিস আমি দেখেছিলাম। এক. তিনি শত্রু-বন্ধু সবাইকে বন্ধু বলে ভাবতেন। শত্রুমানুষ ও বন্ধুমানুষের পার্থক্য যে লোক তাঁর সরলতার কারণে স্বীকার করতে নারাজ, ইতিহাস বলে যে সেই লোক শয়তান পরিবেষ্টিত পড়ে বেশি, আর মানুষ পরিবেষ্টিত কম। দুই. তিনি গাছপালা, পাখি, প্রকৃতি প্রবল ভালোবাসতেন। তাঁর কারাগারের রোজনামচায় পড়েছিলাম তিনি লিখেছেন: ‘বৃষ্টি পেয়ে দূর্বা ঘাসগুলি বেড়ে উঠেছে লিকলিক করে, সমস্ত মাঠটা দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে।’ কিংবা ‘আবার ফুলের বাগানে। একটা মাত্র বন্ধু ফুলের বাগান। ওকে আমি ভালোবাসতে আরম্ভ করেছি।’ কিংবা ‘রাতে যখন ঘুমাতে পারি না, তখন মনে হয় আর এখানে থাকব না। সকালবেলা যখন ফুলের বাগানে বেড়াতে শুরু করি, তখন রাতের কষ্ট ভুলে যাই।’ কিংবা ‘আমার ঘরটার কাছের আমগাছটিতে রোজ ১০-১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালোবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। কয়েক দিন ওদের দেখা পাই না। রোজই আমি ওদের খুঁজি। ওরা কি আমার ওপর রাগ করে চলে গেল?...পাখি দুইটা যে আমার কত বড় বন্ধু।’
আমার উপন্যাসের পুরোটা জুড়ে তাই শত্রুমানুষ ও বন্ধুমানুষের ভেদাভেদের বাড়াবাড়ি। ওই বন্ধুত্ব ও শত্রুত্বের গোড়ার কথাটা এমন যে পৃথিবী তার মূল চেহারাতেই সহিংসতা ও বেইমানি দিয়ে ভরা। আর সহিংস মানুষটারও আবার বন্ধু থাকে এবং বেইমান মানুষটারও থাকে অনেক সহযোগী। ওরা ওভাবে আমাদের চারপাশে গিজগিজ করে থাকে পৃথিবীতে বন্ধুত্বের বা ভালোর বা আলোর অভাব আছে বলেই। উপন্যাসের আমি লিখেছিলাম: ‘তার মানে ঘরের মধ্যে প্রথমে থাকতে হবে আলো, তারপর হঠাৎ নিভে যেতে হবে মোমবাতিটাকে, তার তখন যে-অন্ধকার নেমে আসবে, সেটারই নাম শয়তান। অর্থাৎ কিনা প্রথম থেকে ঘর অন্ধকার থাকলে শয়তান আছে বলা যাবে না—শয়তানকে হতে হবে আলো ও ভালোর অনুপস্থিতির প্রতীক।’ ‘বঙ্গবন্ধু’, আমার উপন্যাসের খসড়া নোটে দেখি সাংকেতিক ধরনে আমার হাতে লেখা, ‘আসলেই মানুষ ভালো। প্রচুর আলো। পাকিস্তানিদের বিদায় বলে হুড়মুড় অন্ধকার ডেকে আনেন চারপাশে। লিখতে হবে যে তাঁর মোমবাতি নিভে গেল যেই না তিনি বলে বসলেন—এই মাটি বাঙালির, পাঞ্জাবি এলিটরা গেট আউট।’
আর তাঁর বৃক্ষপ্রেম ও পাখিপ্রেম আমার উপন্যাসে এতটাই জারিত হয়ে আছে যে অনেক পাঠক আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘ভাই, গাছপালা নিয়ে এতে এতটা বাড়াবাড়ি কেন?’ শুরুতেই, যেখানে আগস্ট মাস এসে গেছে বলে বিমর্ষ নায়কের মন এলোমেলো, আমি লিখেছিলাম: ‘সন্ধ্যা নেমে গেল ঘন হয়ে। মাগরিবের আজান শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ, কিন্তু তার হারানো সুরে এখনো থিরথির করেছে হাওয়া, আর বহু পাখি উত্তর দিকের বালু নদের ওদিক থেকে এসে বসছে বড় বড় সব দেবদারু, শিরীষ ও কাঁঠালের ডালে, ঝগড়া করছে ওরা।’ কিংবা টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর দাফনের অংশে: ‘টুঙ্গিপাড়ার জন্য আমার বুক হাহাকার করে উঠল। ওই মানুষটা স্বাভাবিক মৃত্যু পাননি, পেলে নিশ্চয়ই তাঁকে বহু বছর ধরে চেনা পাখিদের দল, জলের ছোট সুন্দর মেটে সাপ ও ভেসে থাকা সাদা শাপলা ফুলের থোক তাঁর কাছ থেকে বিদায়ের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়টুকু পেত।’
এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক না যে আগস্ট আবছায়াতে নিয়ে আসা শত শত গাছপালার জাতপাত নিয়ে বৃক্ষবিদ ও নিসর্গ লেখক মোকারম হোসেনের একটা বই বেরোচ্ছে এ বছর, নাম: আগস্ট আবছায়ার মায়াবী বৃক্ষেরা। নামটা আমার মনে ধরেছে কেবল ওই ‘মায়াবী’ শব্দটার কারণে। সাংঘাতিক কথা এটাই যে ট্র্যাজেডি করুণ, আর যা কিছু করুণ তার মধ্যে বিশাল মায়া লেগে থাকে চিরকালই। আবার মানুষের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য ওঠে আর নামে, কারণ পরিস্থিতি বদলায়, মানুষ বদলায়, যেহেতু সময় বদলে দেয় সবকিছু। বদলে যাওয়া সময়কে ইতিহাসের শৃঙ্খলার বাইরে দাঁড়িয়ে (যে ইতিহাসের মধ্যে এক পরিবারের অতগুলো লোককে আবছায়া এক ভোররাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে মেরে ফেলার কথা আছে) ধরবার চেষ্টা করাটা চিরকালই এক ধৃষ্টতা, এক মন-খারাপ-করা কাজ। সেটা এককথায়, কারও বেডরুমে অনধিকার প্রবেশ। লেখার এই ফিলোসফিক্যাল সমস্যাজর্জরিত মুহূর্তটার সামনে হাজির হয়ে আমার মনে হলো, কেবল ভাষাকে মায়াবী করে তোলার মাধ্যমেই সম্ভব ওই অনধিকার চর্চাটা করা, ওই লাশগুলোর শাড়ি ওপরে উঠে যাওয়ার, জামা ছিঁড়ে যাওয়ার জঘন্য দৃশ্যটাকে দেখে ফেলবার নোংরামি বা ভায়োলেন্সকে সামলানো।
ট্র্যাজিক কোনো ইতিহাসের বর্ণনা সাহিত্যিক যখন লিখতে বসেন, তখন অবধারিতভাবে কারিগরি ভাষায় তাঁর আর কুলায় না। তাঁকে তখন মায়ার লিরিক্যাল ভাষা দিয়ে বাঁধতে হয় সবকিছু। আবার অন্য বিচারে, এত বড় নৃশংসতাকে মায়া দিয়ে ধরতে চাওয়ার সাহিত্যিক চেষ্টা চিরকালই একটা ধোঁকার কাজ, লেখকের তরফ থেকে এক চালাকি। আগস্ট, ১৫ আগস্ট, তাই ইতিহাসবিদদের কাছে সাফ-সাফ, স্পষ্ট; কিন্তু কোনো ঔপন্যাসিক বা কবির কাছে সে অস্পষ্ট, সে আবছায়া।
১৫ আগস্টের মৃত্যুগুলো নিয়ে আমার এই হতোদ্যম ভাবপ্রবণতা, মায়াবী লিরিসিজিম দিয়ে সেই ভোরের রক্তের জোয়ারটাকে বাঁধ দেওয়ার এই চেষ্টা—পুরোটাই আদতে এক বিষণ্ণ কাজ। বিষণ্ণতা। ব দিয়ে তৈরি আরেক শব্দ সে। ম-দিয়ে নাম কিন্তু ব-দিয়ে বাঙালি এক ব্রুটাসের সেই ভোরে ব দিয়ে বিভীষিকা ছড়ানো ব দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা ও বেইমানির প্রকাশটুকু যে ব দিয়ে বর্বরতার মাধ্যমে ব দিয়ে নাম বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ির ওপরে ছিন্নভিন্ন ছুড়ে দিয়েছিল, আজ পাঁচ বছরের দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়, উপন্যাসে সেই ইতিহাসের ভায়োলেন্সটুকু নয়, সেটার ভেতরকার বিষণ্ণতাটুকুই ছুঁতে চেয়েছিলাম আমি।
প্রচুর ঐতিহাসিক নথিপত্রের সাহায্য নিয়েছিলাম আমি ওই বই লিখতে গিয়ে। প্রায় অসম্ভব এক কাজ ছিল সেটা। আজও আমার মনে আছে সেই অসম্ভব কাজটাকে আমি কোনোমতে সামলাতে পেরেছিলাম তাঁর মৃত্যুর ঠিক আগের দুপুরে, ১৪ আগস্ট দুপুরে, ঘটে যাওয়া আজব এক ঘটনার কারণে। তিনি সেদিন, মৃত্যুর মাত্র ১৫ ঘণ্টা আগে, সেঞ্চুরি বা শতাব্দী ফুলে ভরা শঙ্খনদ পুকুরের ছায়ায় দাঁড়ানো ঢাকার বলধা গার্ডেনের উন্নয়নের জন্য বিনা বাক্যব্যয়ে লিখে দিয়েছিলেন সে যুগের দু লাখ টাকার একটা চেক। দেশের টাকশালে তখন টাকার কতো টানাটানি। কিন্তু তার মধ্যেই মৃত্যুর ১৫ ঘণ্টা আগে তিনি অতগুলো টাকা দিয়ে গেলেন গাছ-পাখির জন্য। এটার ভেতরে যেমন বেদনা ও রহস্য দুইই আছে, তেমন আবছায়া এক না বলা কথা আছে যে—আমি মারা যাচ্ছি, এখন তোমাদের বিশ্বপ্রকৃতির জন্য শেষ মায়াটা দেখিয়ে গেলাম।
আগস্টের এই জায়গাগুলোই আবছায়া, যেমন এর পুষ্পিতা ও মাধবীলতার ঝাড়, যেমন এর পূর্ব ভাগ ও উত্তর ভাগহীন গাঢ় বেদনার টানা সুর। কিন্তু এর বাকিটা—কীভাবে ব্রুটাসের বাহিনী সিস্টেমেটিক তাঁকে ন্যানো সেকেন্ড বাই ন্যানো সেকেন্ড প্ল্যান করে মেরেছিল এবং কীভাবে নিপুণ এক প্রফেশনালিজম দেখিয়ে তারা তাঁর দাফন সম্পন্ন করেছিল, সেগুলো কোনো দিনই অস্পষ্ট নয়। ‘মানুষের কাজগুলো অস্পষ্ট সব আবছায়া দিয়ে ভরা, আর শয়তানের কাজ স্পষ্ট দৃঢ়তার, যেন বজ্রালোক,’ বলে গেছেন সাধু অগাস্তিন।
বজ্রালোক শব্দটাও ব্রুটাসের মতো ব দিয়ে, কিন্তু সেটা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই যায় বেশি।
মাসরুর আরেফিন: লেখক, সিটি ব্যাংকের সিইও।